লক্ষন বর্মন/ হাজী জাহিদ হোসেন,পলাশ,নরসিংদী:
পলাশ উপজেলার টার্কি খামারী ব্যবসায়ী রউফ, জাবেদ, বিষ্ণুসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়,টার্কি পালনে সফল পলাশের খামারীরা। টার্কি এক সময়ের বন্য পাখি হলেও এখন একটি গৃহ পালিত বড় আকারের পাখি। এটি গৃহে পালন শুরু হয় উত্তর আমেরিকায়। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপসহ পৃথিবীর সবদেশে পালন করা হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যতালিকায় অন্যতম উপাদান। টার্কি পালনের সুবিধা হলো, এটা ঝামেলাহীন ভাবে দেশী মুরগীর মত পালন করা যায়। টার্কির মাংস উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপক। টার্কি ব্রয়লার মুরগীর থেকে দ্রুত বাড়ে। টার্কি পালনে তুলনামূলক খরচ কম, কারণ এরা দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি ঘাস,লতাপাতা খেতেও পছন্দ করে। টার্কির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ওঠার ছয় মাসের মধ্যে টার্কি ডিম দেয়। ছয় মাসের মেয়ে টার্কির ওজন হয় পাঁচ থেকে ছয় কেজি। আর পুরুষগুলো প্রায় আট কেজি। আমেরিকায় টার্কির রোস্ট অভিজাত খাবার। আমাদের দেশে মুরগির মাংসের মতো করেই টার্কি রান্না করা হয়। রোস্ট ও কাবাব করা যায়। আবদুল রোউফ মিয়ার সাথে কথা বলে জানা যায়, পলাশে বাণিজ্যিকভাবে এত বড় পরিসরে আর কোনো টার্কির খামার নেই। এই খামার থেকে পাইকারি ক্রেতারা কিনে নিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করেন। সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় এখনো দাম একটু বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে টার্কি খাওয়ার প্রচারন শুরু হয়নি। পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌরসভার বালুচর পাড়ার কয়েকজন টার্কি মুরগি ক্রেতা বলেন, আবদুল রউফ মিয়া এলাকার মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে অনেক শৌখিন খামারি ছোট আকারে টার্কি পালন শুরু করেছেন। তিনি নিজে এর মাংস খেয়েছেন। খেতে সুস্বাদু। টার্কির একজন পাইকারি ক্রেতা মো, সাঈদ বলেন, পলাশের আবদুল রউফ এর খামার সবচেয়ে বড়। তাঁর কাছ থেকে সাশ্রয়ী দামে কেনা যায়। এই টার্কি তিনি ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করেন। খাসির মাংসের মতো স্বাদ। আবদুল রউফ এইচএসসি পাস করার পর উয়েলডিং এর উপর এ.ডাল্বিউএস. কোর্চ করে সিঙ্গাপুর গিয়ে এসোসিয়েশন অব সিঙ্গাপুর মেরিন, ফায়ার ফাইটিং এর ট্রেডিং করে ফোরম্যান হয়ে আমরিকা,ইউরোফ, আফরিকা সহ এশিয়ার বিভিন্ন মহাদেশে ইটালিয়ান কোম্পনি ই.ন.আই.এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা বেতনে কাজ করেছেন। ২০১৩ সালের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। গ্রামে এসে তিনি ৩৩ শতাংশ জমি কিনে বর্তমান খামারটি শুরু করেন। বিদেশ থাকার সময় টার্কির মাংসসহ কাবাব, রোস্ট খেয়েছেন তখনই ভাব ছিলেন, আমাদের দেশে কিভাবে এ খামার করা যায়? এবং সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। টার্কিতে রয়েছে, রোগ প্রতিরোদের ক্ষমতা। টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণ জিংক, লৌহ, পটাশিয়াম, বি৬ ও ফসফরাস থাকে। এ উপাদানগুলো মানব শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী। এবং টার্কির মাংসে এমাইনো এসিড ও ট্রিপটোফেন অধিক পরিমাণে থাকায় এর মাংস খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। টার্কির মাংসে ভিটামিনও অধিক পরিমাণে থাকে। ফেট নেই, চর্বি কম, প্রচুর পরিমাণে কেলারী আছে। যারা গরুর মাংস খেতে পারে না তাদের জন্য টার্কির মাংস উপকারী। ডায়েবেটিস রোগীদের জন্য সহায়ক। সকল পশুর মাংস থেকে দামে কম এবং স্বাদ বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়ায় টার্কি বাঁচে কি না, তাঁর ধারণা ছিল না। খোঁজ নিতে থাকেন। জানতে পারেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই বাণিজ্যিকভাবে টার্কির চাষ হয়ে থাকে। যার প্রতি জোড়ার দাম পড়ে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি ৮ টি টার্কি সংগ্রহ করেন। এই ৮ টি টার্কির মধ্যে মোরগ ৪টি এবং মুরগি ৪টি। তিনি টার্কি পালনের পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। সেভাবেই কাজ শুরু করলেন। রউফ দেখলেন, টার্কির খাবার নিয়ে মুরগির চেয়ে দুর্ভাবনা কম। এরা ঠান্ডা-গরম সব সহ্য করতে পারে। দানাদার খাবারের চেয়ে কলমির শাক, বাঁধাকপি, ঘাস বেশি পছন্দ করে। এগুলো জোগাড় করা সহজ। টার্কিগুলো শুরু থেকেই ডিম দিতে থাকে। ডিম ফোটানোর জন্য রউফ ৪০ টি দেশি মুরগি জোগাড় করলেন। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি টার্কি এই মুরগির মধ্যে ছেড়ে দিলেন। পাশাপাশি তিনি তিতির পাখিও পুষতে শুরু করেছিলেন। তিতির ও টার্কি পালন নিয়ে একটা আস্থা তৈরি হলো তাঁর। গত কয়েক বছরে তিনি ৮ টি টার্কি থেকে প্রায় ৫০০ টার্কি বিক্রি করেছেন। বর্তমানে খামারে রয়েছে প্রায় শতাধিকের উপরে টার্কি। এখন ডিম দেওয়ার উপযোগী প্রতি জোড়া টার্কি বিক্রি করছেন আট হাজার টাকায়। রউফ বলেন, প্রথমে তিনি ডিম ফোটানো নিয়ে একটু বিপাকে পড়েন। যন্ত্রের সাহায্যে ২৭ দিনে টার্কির ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। আর তিতিরের ২৪ দিন লাগে। রউফ আরো বলেন, যারা অল্প পুঁজি এবং ঝুকি নেই এমন ব্যবসা খোঁজছেন টার্কির খামার তাদের জন্য আয়ের উৎস হতে পারে। কারণ একটি টার্কির খামার করতে বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য পাখির তুলনায় এর রোগ বালাই কম এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে খামারে ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। খামারের খরচ কম, এক মাসে ১শত টার্কি পিছনে ৩০ হাজার টাকা খরচ হবে এবং বিক্রি করা যায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। টার্কি মুরগি পালনকারীরা শুধু সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন একটি টার্কি মুরগির জন্য ৪-৫ বর্গ ফুট জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, একটি মোরগের সঙ্গে ৩ বা ৪ টি মুরগি রাখা যেতে পারে। ডিম প্রদান কালীন সময়ে টার্কিকে অদর্শ খাবার এবং বেশি পানি দিতে হবে। রউফ এর খামারে গিয়ে দেখা যায়, সাত রঙের টার্কি আছে, কালো,সাদা কালো, সিলভার লাইট, প্রেস সাদা, রয়েল, টাইগার,স্প্রাইট। আবদুল রউফ এর মতো এত রঙের টার্কি পলাশে আর কোথাও নেই। তিথী পাখি রেখেছেন মানুষকে আকর্ষনের জন্য। এব্যাপারে পলাশ উপজেলার পশু হাসপাতালের কর্মকর্তা সাজ্জাহান খান বলেন, টার্কির উপর আমরা সব সময় নজর রাখছি। খামারিদের কে নিয়ে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌর মেয়রসহ ট্রেডিং সেমিনার করেছি। টার্কি মুরগির রানী ক্ষেত, ডান্টা,বসন্ত, টিকা দিলে এসব রোগ প্রতিরোদ হয়। অন্যান্য মুরগির মাঝে সাত থেকে আটটি রোগ হয়। এখন একটু দাম বেশি হলেও প্রডাকশন যত বেশি হবে বাজারে তত দাম কমে যাবে। এক কেজি খাসির মাংসের মূল্য ৮শত টাকা, এক কেজি টার্কির মূল্য ৩শ টাকার কিছু উপরে। একটি টার্কির ওজন খাশির সমান বিধায় টার্কি মূল্য কম। কর্মসংস্থার জন্য ব্যবসায়ীক ভাবে সফল এবং লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে সারা বাংলাদেশের মধ্যে পলাশে টার্কির খামার বেশি এবং উল্লেখযোগ্য, পলাশে প্রায ছোট, বড়, মাজারী ধরনের ৪৫ টি খামার আছে। এর মধ্যে মিশু,জাবেদ, বিষ্ণু সহ অনেকেই এখন ধাফে ধাফে টার্কি ব্যাপক পরিষরে বৃদ্ধি পাছে। কারণ টার্কিতে রোগ প্রতিরোদ ক্ষমতা বেশি।