লক্ষন বর্মন, নরসিংদী: ঈদকে সামনে রেখে সরগরম দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারী কাপড়ের বাজার নরসিংদীর বাবুরহাট। ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারনায় মুখরিত হাটের অলিগলি। দম ফেলার যেন ফুরসত নেই কারও। গত বছরের তুলনায় কাপড়ের দাম বাড়লেও বেচাকেনা বেড়েছে কয়েকগুন। তাই খুশি হাটের বিক্রেতারা।
কাপড়ের জন্য নরসিংদীর বাবুহাটের খ্যাতি দেশজুড়ে। আর সেই কাপড়ের জন্য সারা দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা ভীড় জমিয়েছে দেশের বৃহত্তর পাইকারী কাপড়ের হাট বাবুরহাটে। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন রঙ আর ডিজাইনের তৈরী শাড়ী,লুঙ্গি ও থ্রি-পিস সহ নানা পোষাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হাটের প্রায় কয়েক হাজার দোকানী। পাইকারী ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে হাটের অলিগলি। ঈদকে কেন্দ্র করে নিত্য নতুন ডিজাইনের থ্রী-পিছ, শাড়ি ও লুঙ্গিকে বিভিন্ন দৃষ্টি নন্দন নামে নামকরণ করা হয়েছে। রমজান শুরুর সাথে সাথেই বেচা-বিক্রির ধুম পড়ে যায়। ঈদের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত চলবে বেচা-বিক্রি। অন্যন্য বছরের তুলনায় কয়েকগুন বিক্রি বাড়ায় ব্যবসায়ীরা খুশি।
বাজারের ব্যবসায়ীরা জানায়, নরসিংদী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে সদর উপজেলার শীলমান্দি ইউনিয়নে অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি কাপড়ের বাজার বাবুরহাট। ১৯৩৪ সালে জমিদার হলধর সাহা প্রায় ১১ একর জমির উপর হাটটি প্রতিষ্ঠা করে। অল্প সময়ের মধ্যেই বাবুরহাট দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে।
এক সময় এ অঞ্চলে মসলিন কাপড় তৈরি হতো। তৈরি হতো মসলিনের উপযুক্ত সুতা কিন্তু ইংরেজ আগমনের পর এ দেশে সুতা তৈরি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাঁতিরা কলে তৈরি সুতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইংরেজ আমলে বিলেত ও বোম্বে থেকে সুতা আমদানি হয়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ ও পরে বাবুরহাটে আসত।
বর্তমানে এ হাটে ৫ হাজারেরও অধিক দোকান আছে। এক সময় কেবল রবিবারেই হাট বসত। এখন সপ্তাহে দুইদিন শুক্র ও শনি হাট বসে। তবে ঈদ সামনে রেখে পুরো সপ্তাহ এখন চলছে কেনাবেচা। এখানে বিক্রি হওয়া থান কাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, সুতি, শাড়ি, লুঙ্গি ও থ্রী-পিছউৎপন্ন হয় স্থানীয় তাঁত ও সহায়ক শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে। একই সঙ্গে অন্যান্য স্থান থেকে উৎপাদিত নাইট কুইন, দেশি জর্জেট, লেজার জর্জেট, জাপানি সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানী, কাঁতানসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ের সম্ভারে বাবুরহাট এখন বৈচিত্রময়। হাট থেকে কেনা কাপড় চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, খুলনা, বগুড়া, হবিগঞ্জসহ দেশের প্রায় সব জেলায়। এই হাট ঘিরে নরসিংদী জেলাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে গড়ে উঠেছে কয়েক লাখ তাঁতকল। একইভাবে কয়েকশ সহায়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা ভীড় জমিয়েছে বাবুরহাটে। ফলে হাটের সরু গলিগুলোতে সারাক্ষণ ভীড় লেগেই রয়েছে। হাটের দোকানগুলোতে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন প্রকারের কাপড়। পাইকারী ক্রেতারা রঙ ও ডিজাইন দেখে পছন্দমত আলাদা ভাবে জড়ো করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতাদের যুক্তি তর্কে মিলছে বিকিকিনির সমাধান।
একযুগ ধরে বাবুরহাটে আসছেন হবিগঞ্জের কাপড় ব্যবসায়ী সাজু মিয়া। তিনি বলেন, নিরাপদ পরিবেশ ও এক স্থানে সকল কাপড় পাওয়া যাওয়ায় আমরা এই হাটে আসি। এখান থেকে কাপড় নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসা করছি। এবারও ঈদের মৌসুমও তার ব্যতিক্রম নয়। রোজার প্রথম দিকে নেওয়া চালানের কাপড় প্রায় শেষ কিন্তু ঈদের এখনো বাকী। তাই ফের কাপড় কিনতে হাটে এসেছি।
কাপড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সাশ্রয়ী মূল্যে কাপড় কিনতে হাটে ভীড় করছে সাধারণ ক্রেতারাও। ঢাকার বাসাবো থেকে আসা গৃহবধু মেহনাজ বেগম বলেন, ঈদে নিজের পরিবার ও স্বজনদের জন্য অনেক কাপড়ের প্রয়োজন হয়। গত কয়েক বছর ধরে আমি বাবুরহাটে ঈদের কেনাকাটা করছি। এক স্থানে অনেক প্রকারের কাপড় পাওয়া যাওয়ায় সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়।
দেশের নামীদামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঈদের মৌসুমে বাবুরহাটের ব্যবসায়ীরাও কাপড়ে এনেছেন আধুনিকতার আঙ্গিক। পাকিজা ফ্যাশন কালেকশনের এজিএম শংকর সাহা বলেন, এবারের ঈদে পাখি বিপি, লোƒকাস বিপি, রূপকথা বিপি, জারাজারা বিপি, ফুলমনি বিপি, বেনারশী বিপি, চাইনা বিপিগোল্ড, আশা বিপিগোল্ড, কলকাতা বিপি, থ্রী-পিছের চাহিদা বেশী। বাজারে পাইকারী আগমন বেশ, তাই বিক্রিও ভাল হচ্ছে।
রমজানের প্রথম থেকে শুরু হওয়া ঈদের বিকিকিনি শেষ পর্যায়ে চলে আসায় পাইকারী ক্রেতা বেশি থাকলেও অধিকাংশ দোকানেই কমে গেছে কাঁপড়ের পরিমাণ। রমজানের শুরুর দিকে বেচা-বিক্রি কম হলেও ঈদের আগে বিক্রি বাড়ায় খুশি ব্যবসায়ীরা।
পাকিজা লুঙ্গি কালেকশনের ব্যবস্থাপক মেরাজুল হক বলেন, ক্রেতাদের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে আমরা লুঙ্গীতে নতুনত্ব এনেছি। যা ৩৩০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে বাটিক ও হুইপ জ্যাকেট লুঙ্গীর ভাল সাড়া পাওয়া গেছে। ঈদ উৎসবে অন্যান্য পোষাকের সঙ্গে চাই নতুন লুঙ্গী। তাই অন্যান্য বছরের মতো এবারও ঈদে লুঙ্গির ভাল বিকিকিনি হচ্ছে।
বাবুরহাট মানে কাপড়ের ভাজে ভাজে রঙের গন্ধ। বেশী ক্রেতা বেশী বিক্রি। তবে এবারের ঈদ বাজার নিয়ে সন্তুষ্ট নয় ব্যবসায়ীরা।