সোস্যাল ডেস্ক,নরসিংদী প্রতিদিন, মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৮:
ঢাকায় কে এই নবাব?নবাবী গেছে বহু আগে। কিন্তু, বাংলা ভাষায় ‘নবাবী চাল’ প্রবাদ সার্থক করে চলেছেন তিনি। কুরসিনামায় টিকিটি পর্যন্ত নেই, অথচ নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন নবাব বংশের উত্তরসূরি। শুধু তাই নয়, নবাব বংশের বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারেও ‘আদা-জল’ খেয়ে নেমেছেন। বিভিন্ন সংগঠন গঠন করে তাদের অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন, নবাবী তাশরিফ দিচ্ছেন। যতটা না বাস্তবে, তার চেয়ে বেশি সক্রিয় ফেসবুকে। খায়েশ আছে স্বামী-স্ত্রী মিলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার।
তিনি আলি হাসান আসকারী। নবাব বংশের উত্তরাধিকার দাবি করে নামের আগে জুড়ে দিয়েছেন নবাব। অথচ ফেসবুকের এই নবাব নিয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে পাওয়া গেছে বিস্ময়কর সব তথ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার বিখ্যাত নবাব সলিমুল্লাহর বংশের উত্থান আঠারশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। ওই সময় ঢাকায় ব্রিটিশ কর্তৃক নিয়োজিত জমিদার কাশ্মীরের বংশোদ্ভূত আবদুল গণি নবাব বংশের গোড়াপত্তন করেন। তবে বাংলায় উনার নাতি স্যার সলিমুল্লাহ-ই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। পুরান ঢাকার ইসলামপুরে ‘আহসান মঞ্জিল’কে নবাবদের বাড়ি বলেই জানে ঢাকাবাসী। বর্তমানে ঢাকায় আগের নবাবি জৌলুশ না থাকলেও এই বংশের উত্তরাধিকারীদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৪০০ জন ছুঁয়েছে।
মূলত ১৯৫৯ সালে ঢাকার নওয়াব পরিবার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই সব ধরনের কার্যক্রমও করে আসছে ‘মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট’ এবং ‘নবাবী স্টেট’।
ট্রাস্টের সদস্যদের পূর্বপুরুষ নবাব বংশের হলেও নবাবী পাননি। এজন্য তাদের উপাধি ‘খাজা’। আর নবাবী পেয়েছেন যারা, তারাই স্টেটের সদস্য।
উভয়পক্ষের কাছেই নবাব বংশের তালিকা (কুরসিনামা) আছে। কিন্তু, ঢাকায় হঠাৎ আবির্ভাব হওয়া নবাব আলি হাসান আসকারীর নাম এই দুই কুরসির কোথাও পাওয়া যায়নি।
অথচ আলি হাসানের দাবি, তিনি খাজা আমানুল্লাহর ছেলে। একপক্ষের কুরসিতে অবশ্য খাজা আমানুল্লাহর নাম পাওয়া গেছে। তার শুধু দুজন কন্যাসন্তান রয়েছে, তারা কানাডায় বসবাস করেন। কিন্তু, সেখানে আলি হাসান আসকারী নামে কোনো ছেলেসন্তানের নাম নেই।
আবার আলি হাসান আসকারী নিজেও ফেসবুকে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেন। নিজেকে আগে পাকিস্তানের নাগরিক বলে পরিচয় দিলেও সম্প্রতি ফেসবুকে লেখেন, তার জন্ম সৌদি আরবে।
ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারাও কুরসি ঘেঁটে দেখেছেন, আলি হাসান আসকারী নামে ঢাকার নবাব বংশে কেউ, কখনই ছিলেন না। তিনি ফেসবুকে প্রচারণা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজেকে নবাব বংশের অন্যতম উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করছেন।
আলি হাসান আসকারীর ফেসবুকের নাম নওয়াব আলি হাসান আসকারী (আওরঙ্গজেব)। শুধু ফেসবুকই নয়, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তিনি নিজেকে এই নামেই পরিচয় দিচ্ছেন। আর বলছেন, তার দাদা (দাদার-দাদা) নবাব স্যার সলিমুল্লাহ।
নিজের দাবির পেছনে যৌক্তিকতা তুলে ধরে আলি হাসান আসকারী বলেন, ‘নবাব বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন আবদুল গণি। উনার ছেলে নবাব আহসানুল্লাহ। আহসানুল্লাহর ছেলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। সলিমুল্লাহর ছেলে নবাব হাবিবুল্লাহ। হাবিবুল্লাহর ছেলে নবাব হাসান আসকারী। হাসান আসকারীর ছেলে আমানুল্লাহ। আর নবাব আমানুল্লাহর ছেলে হলাম আমি নবাব আলি হাসান আসকারী।’
তবে আলি হাসান আসকারীর দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলেছেন মৌলভী খাজা আবদুল্লাহ ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের সভাপতি ও নবাব বংশের সদস্য খাজা মো. সাঈদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা উনাকে (আলি হাসান আসকারী) চিনি না। উনার নাম কখনো শুনিনি। আবদুল্লাহ ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টে সংগৃহীত কুরসিনামায় এই নামের কেউ নেই। তিনি আমাদের বংশেরও কেউ নন।’
নবাব পরিবারের অন্য শাখা ঢাকা নবাব এস্টেট বি, ই, প্রোপ্রাইটর্স অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বেগম ফারহানা ইব্রাহিমও বলেন, ‘নবাব আলি হাসান আসকারী আমাদের পরিবারের কেউ নন। তিনি নিজে নিজেই নবাব পরিচয় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা কেউ তাকে চিনি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলি হাসান যাকে বাবা (আমানুল্লাহ আসকারী) দাবি করছেন, তারও নাম আমাদের কুরসিতে নেই।’
নবাবের উত্তরসূরি দাবিদার আলি হাসান আসকারী জানান, পরিবার নিয়ে তিনি বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় বসবাস করছেন। তবে ব্যস্ততার কারণে বাইরেই বেশি থাকা হয়।
নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার বর্তমান বয়স ৪০ বছর। জন্ম পাকিস্তানে হলেও পরে নেদারল্যান্ডসে চলে যাই। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশে আসি। এখন গোটা দেশ ঘুরে দেখছি।’
আলি হাসান আসকারী নিজেকে খাজা আমানুল্লাহর ছেলে হিসেবে বরাবরই পরিচয় দেন। আমানুল্লাহ নবাব খাজা হাসান আসকারীর ছেলে। নবাব হাসান আসকারী ছিলেন নবাব হাবিবুল্লার জ্যেষ্ঠ পুত্র। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকবাহিনীর সহযোগিতা করায় হাসান আসকারী বিতর্কিত হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৮৪ সালের ৯ আগস্ট করাচিতেই হাসান আসকারী মারা যান।
সৌদি আরব না পাকিস্তান- জন্মস্থান বিভ্রান্তির বিষয়ে আলি হাসান আসকারী জানান, তার জন্ম পাকিস্তানে। ‘তাহলে যে ওমরা হজ করতে যাওয়ার আগে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিলেন জন্ম সৌদি আরব?’-এমন প্রশ্নে আলি হাসান আসকারী চুপ করে যান।
আলি হাসান আসকারীর এই বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার পেছনে নবাব বাড়ির সম্পত্তি দখল ও রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করে তোলার চেষ্টা রয়েছে বলে নবাব পরিবারের আসল সদস্যরা জানিয়েছেন।
নবাব বাড়ির নাম ভাঙিয়ে ইতোমধ্যে আলি হাসান আসকারীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এসএম হল, স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানা, বুয়েটসহ নানা জায়গায় অবস্থান তৈরির চেষ্টা করতেও দেখা গেছে।
এদিকে, গত বছরের ডিসেম্বরে ভুয়া নবাবের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে নবাব পরিবারের সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্বে থাকা মতিঝিলের ভূমি সংস্কার বোর্ডের ম্যানেজার বরাবর আবেদন করেছিলেন ফারহানা ইব্রাহিম। এরপর ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছেও তিনি একই আবেদন করেন।
আলি হাসান আসকারী জানান, ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর প্রথমেই স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানার পাশে হাত বদল করে গড়ে ওঠা ১৮ তলা বিল্ডিংয়ের জমির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে তিনি রিট দায়ের করেন।
অথচ অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই ভবনের নির্মাণ বাতিল করার আবেদন চেয়ে আদালতে রিট করেন এতিমখানার চার ছাত্র। পরে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আদালত রিটকারীদের পক্ষে রায় দেন। সেই সঙ্গে ৩০ দিনের মধ্যে ওই ভবন ও সম্পত্তি এতিমখানাকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখাতে না পারলেও নবাব বংশধরদের দাবি, আলি হাসান আসকারী নিজেকে ‘নবাব’ পরিচয় দিয়ে মানুষকে বিভিন্নভাবে ঠকাচ্ছেন। প্রত্যেকেই তাকে ‘ভুয়া নবাব’ বলে সম্বোধন করেন।
এ বিষয়ে নবাব হাবিবুল্লাহর বংশধর পরীবাগ বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার ঢাকা নওয়াব স্টেটের খাজা হাবিব বলেন, ‘নবাব পরিচয়ধারী আলি হাসান আসকারীকে আমি চিনি না। তিনি আমাদের বংশের কেউ নন।’
ঢাকার নবাব পরিবারের যাবতীয় সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্বে থাকা মতিঝিলের ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি সংস্কার বোর্ডের তালিকাতেও আলি হাসান আসকারী নামে নবাব পরিবারের কোনো সদস্যকে পাওয়া যায়নি।
আলি হাসান আসকারী বলেন, ‘আমি আপাতত আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ফেসবুকে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। শিগগিরই মাঠে নামব।’
সূত্র: সোস্যাল মিডিয়/সৈয়দ অদিত/দৈনিক খোলা কাগজ