নিজস্ব প্রতিবেদক,নরসিংদী প্রতিদিন,মঙ্গলবার,২২ মে ২০১৮: সংসারের অভাব-অনটন দূর করা এবং পরিবারের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে অনেক শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন। যাদের একটি বড় অংশ নারী শ্রমিক। তাদের স্বপ্ন থাকে পরিবারের সুখের জন্য কিছু টাকা উপার্জন। কিন্তু বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকদের বেলায় ঘটছে তার ঠিক উল্টোটা।
নারী শ্রমিকদের শ্রম যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে ভাগ্যে জুটেছে নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন। কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি কিছু। গত শনিবার রাতে বিদেশ থেকে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান ৭৮ নারী। এর আগে গত শুক্রবার দেশে ফেরেন পাঁচ নারী। তারা সবাই নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন।
সৌদি থেকে ফেরত আসা সালমা নামে এক নারী জানান, সেখানে (সৌদি আরব) নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হন। আমার পাসপোর্ট রেখে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আমি পালিয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসে আসি। দূতাবাস আমাকে আউট পাস দিয়ে দেশে পাঠিয়েছে। আমাকে গালাগালি করত, খেতে দিত না ঠিকমতো। গৃহকর্মী শ্রমিক তসলিমা আক্তার জানান, তিনি যে বাড়িতে কাজ পেয়েছিলেন সেখানে লোক ছিল ৪৫ জন। এই বাড়িতে প্রায়ই তিনি নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা কয়েক নারী শ্রমিকরা জানান, এখনো অনেক নারী সৌদি আরবে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর আগে গত এপ্রিলে সৌদি আরব থেকে প্রায় অর্ধশত নারীকে একই কারণে ফিরিয়ে আনা হয়। অবশ্য এ ধরনের ঘটনা শুধু সৌদি আরবেই নয়, আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবানন ও কাতারের মতো মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে নারী কর্মীরা যাচ্ছেন, তার প্রতিটিতেই কমবেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও থামানো যাচ্ছে না মধ্যপ্রাচ্যের নিয়োগকর্তাদের নির্যাতন।
বিরূপ পরিস্থিতির শিকার নারীরা সৌদি আরবে আর অবস্থানে রাজি না হওয়ায় দূতাবাস তাদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করে।
রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) সারওয়ার আলম গণমাধ্যমকে জানান, ক্যাম্পে থাকা নারীদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, সৌদি আরবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৮০ হাজারের বেশি নারী গৃহকর্মী পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশকেই দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এদের একটি বড় অংশ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সৌদি আরবে অবশ্য শুধু বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরাই নয়, সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ সব দেশের গৃহকর্মীদেরই আছে এবং ছিল। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীর ওপর যৌন নির্যাতনের একটি খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নিন্দার ঝড় তুলেছিল। সে সময় গৃহকর্মীর ওপর যৌন নির্যাতন চালাতে গিয়ে স্ত্রীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েন এক সৌদি নাগরিক। স্বামীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই নারী একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।
২০১৬ সালে এক ভারতীয় গৃহকর্মী মুক্তি চাইলে সৌদি গৃহকর্তা তার ওপর হামলে পড়েন। কেবল তাই নয়, ক্ষুব্ধ হয়ে গৃহকর্তা একটি ছুরি দিয়ে ওই গৃহকর্মীর হাত কেটে ফেলেন। ২০১৭ সালের শেষার্ধে রোমহর্ষকভাবে নির্যাতিত বাংলাদেশি এক নারী কর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিডিও বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। ভিডিওতে চুয়াডাঙ্গার ওই নারীর এক হাতে ক্ষতচিহ্ন, আরেক হাতে গোটা গোটা ফোসকা দেখা যায়। প্রতিদিন তাকে ছয় থেকে সাতবার গরম লোহা দিয়ে ছেঁকা দেওয়াতেই এসব ফোসকার সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার গণমাধ্যমকে জানান, এসব সমস্যার কিছু অংশ বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে। সৌদি নিয়োগকর্তাদের তরফ থেকেও নারী শ্রমিকরা নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
অর্থ লেনদেন:
নিয়মানুযায়ী, সৌদি নিয়োগকর্তা যখন তার দেশের রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে গৃহকর্মী চান, তখন তিনি সেই এজেন্সিকে প্রয়োজনীয় অর্থ দেন। সেই এজেন্সি আবার বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শ্রমিককে কোনো অর্থ দিতে হয় না।
অথচ বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকাও আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্সিগুলো আর্থিক মুনাফার জন্য শ্রমিকদের ‘বিক্রি’ করে দিচ্ছে।
রিক্রুটিং এজেন্সির দায়িত্ব
চুক্তি অনুযায়ী, চাকরির প্রথম তিন মাস পর্যন্ত শ্রমিকের দায়-দায়িত্ব রিক্রুটিং এজেন্সিকে বহন করতে হয়। এরপর গৃহকর্মী শ্রমিকের দায়-দায়িত্ব আর রিক্রুটিং এজেন্সির থাকে না।
চুক্তির দুর্বলতা
২০১৫ সালে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিতে নানা ধরনের দুর্বলতা রয়েছে যার খেসারত দিতে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। এখনো বহু নারী রিয়াদ এবং জেদ্দার ‘সেফহোমে’ বসবাস করছেন এবং বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। দেশে ফিরে আসার জন্য অনেকেই বাড়ি থেকে অর্থ চেয়ে পাঠাচ্ছেন।
ভাষা সমস্যা
সৌদি আরবে যেসব নারী শ্রমিক যাচ্ছেন তাদের অনেকেরই আরবি ভাষার ন্যূনতম জ্ঞানও নেই। ফলে গৃহকর্তার সঙ্গে কথাবার্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রায়ই আকার ইঙ্গিতের সাহায্য নিতে হয় গৃহকর্মীদের। ফিরে আসা শ্রমিকরা বলেন, সৌদি আরবের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে নারীদের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
প্রবাসে কাজ করছে প্রায় সাত লাখ বাংলাদেশি নারী
দিন যতই যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ততই বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে নারী শ্রম অভিবাসীর সংখ্যাও। জিরো মাইগ্রেশন খরচের কারণে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, কুয়েত, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন গ্রামের দরিদ্র অসহায় পরিবারের মেয়েরা। নারী অভিবাসনের অগ্রগতির ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। কেননা নারী অভিবাসীদের কাছ থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স পাচ্ছে।
এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একজন প্রবাসী পুরুষ তার আয়ের মাত্র ৫০ শতাংশ অর্থ দেশে পরিবারের কাছে পাঠান। পক্ষান্তরে একজন নারী প্রবাসী শ্রমিক পাঠান আয়ের ৯০ শতাংশ।
অভিবাসন খরচের অনুপাতে রেমিটেন্স পাঠানোর দিক থেকেও পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নারী শ্রমিকরা। ‘ইমপেক্ট অব মাইগ্রেশন অন পোভার্টি অ্যান্ড লোকাল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এসডিসি ও রামরুর আরেক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, একজন পুরুষ শ্রমিকের অভিবাসনে গড়ে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়। পক্ষান্তরে একজন নারী শ্রমিকের গড় অভিবাসন ব্যয় এক লাখ টাকা, যা পুরুষের তুলনায় এক-চতুর্থাংশের কিছু বেশি। এদিকে একজন পুরুষ শ্রমিক মাসে গড়ে ২৩ হাজার ৮৬ টাকা রেমিটেন্স পাঠান। এটি একজন পুরুষ শ্রমিকের আয়ের ৫০ শতাংশ। পক্ষান্তরে একজন নারী শ্রমিক গড়ে রেমিটেন্স পাঠান ১৩ হাজার ৫২৭ টাকা, যা তাদের আয়ের ৯০ শতাংশ। পুরুষের অনুপাতে নারী শ্রমিকের অভিবাসন খরচ এক-চতুর্থাংশ হলেও পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিক রেমিটেন্স পাঠান অর্ধেকেরও বেশি। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের তুলনায় আয়ের দিক থেকে এগিয়ে নারীরা।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অব ম্যান পাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) তথ্য মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লাখ ৬৪ হাজার জনের কিছু বেশি। এর মধ্যে নারী শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ৬ লাখ ৯৬ হাজার জনের কিছু বেশি। নারী শ্রম অভিবাসীদের বড় অংশ মূলত, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান, লেবানন, কুয়েত, মালয়েশিয়া এসব দেশে কর্মরত রয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মোট নারী শ্রম অভিবাসী হয়েছেন ১ লাখ ২১ হাজার ৯৮৫ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৩ হাজার জন গেছেন সৌদি আরবে। এর বাইরে কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবানন, মালয়েশিয়াতে গেছেন অন্যরা।
নারী শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে। বিএমইটির তথ্য মতে, বর্তমানে সৌদি আরবে ২ লাখ ৪ হাজার ৭২৯ জন বাংলাদেশি নারী অভিবাসী রয়েছেন। অর্থাৎ মোট অভিবাসীর প্রায় ৩০ শতাংশই সৌদি আরবের বিভিন্ন জায়গাতে কর্মরত রয়েছেন। এর পরপরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নারী অভিবাসী দেশ হলো জর্ডান। সেদেশ বর্তমানে ১ লাখ ২৯ হাজার ৮০২ জন নারী অভিবাসী রয়েছেন। শতাংশের হিসেবে মোট নারী অভিবাসীর ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ জর্ডানে রয়েছেন। এরপর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৬ হাজার ১ জন নারী অভিবাসী রয়েছেন আরব আমিরাতে। লেবাননে রয়েছেন ১ লাখ ৪ হাজার ২০৭ জন। ওমানে রয়েছেন ৬৪ হাজার ৬০২ জন।
এর বাইরে পোশাকশিল্প, হাসপাতাল এবং বিভিন্ন কলকারখানাতে নারীরা অভিবাসীরা কাজের সঙ্গে যুক্ত।
১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের পুরুষদের পাশাপাশি বৈশ্বিক শ্রমবাজারে নারীরা প্রবেশ করলেও সেটা ছিল একেবারেই সীমিত পরিসরে। প্রথম দিকে মূলত, দক্ষ নারীরাই বিদেশে কর্ম করার সুযোগ লাভ করে। পরবর্তীতে স্বল্প বা কম দক্ষ নারীদেরও বিদেশে যাওয়ার সযোগ তৈরি হয়।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হজরত আলী বলেন, নারীদের বিদেশে যেতে তেমন খরচ নেই। সেখানে থাকা-খাওয়াও বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন নারী অভিবাসীরা। এসব কারণে সেখানে তাদের ব্যক্তিগত খরচ কম হওয়ায় আয়ের সবটাই রেমিটেন্স আকারে দেশে পরিবারের কাছে পাঠাতে পারেন। এটি পরিবারের প্রতি নারীদের অধিক মমত্ববোধকেই প্রকাশ করে।
সূত্র: খোলা কাগজ