ডেস্ক রিপোর্ট | নরসিংদী প্রতিদিন-
রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০১৯:
মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবাবন্দি দিয়েছে হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী জাবেদ হোসেন ও কামরুন নাহার মণি। মেয়েটি ঘটনার সময় নুসরাত জাহান রাফিকে শোয়া অবস্থায় বুক চেপে ধরেছিলেন। যাতে নুসরাত কোনও নড়াচড়া করতে না পারেন। সে নুসরাতের সহপাঠী।
শনিবার ( ২০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১০টার দিকে পিবিআই’র (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) চট্টগ্রাম বিভাগের স্পেশাল পুলিশ সুপার মো. ইকবাল ওই দুইজনের জবাববন্দির ব্যাপারে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে এসব কথা জানান।
তিনি জানান, জাবেদ হোসেন ও কামরুন নাহার মণি বিকেলে ফেনীর সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শারাফ উদ্দিন আহম্মদের আদালতে তাদের উপস্থাপন করে পিবিআই। জাবেদ হোসেন ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শরাফ উদ্দিন আহম্মেদের সামনে নিজের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোত্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একই আদালতে জাবেদের পাশাপাশি নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে সহায়তাকারী কামরুন নাহার মণিও জবানবন্দি দেন। বিকাল পাঁচটা থেকে রাত সোয়া দশটা পর্যন্ত আদালতে জাবেদ হোসেন ও অপর আসামি কামরুন নাহার মণির জবানবন্দি রেকর্ড হয়।
এসপি ইকবাল বলেন, জাবেদ হোসেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, নুসরাতের গায়ে সে কেরোসিন ঢেলে দেয় এবং ঘটনার পরিকল্পনার সঙ্গেও সে জড়িত ছিলো।
জাবেদ বলেন, ‘কারাগারে দেখা করতে গেলে ওস্তাদ (অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার) আমাদের কিছু একটা করার নির্দেশ দেন। আমরা তাকে বলি- আপনার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা দিয়ে আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে। মাদ্রাসার সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। তখন ওস্তাদ তার বিশ্বস্ত শিক্ষার্থী হিসাবে আমাদের ‘করো, তোমরা কিছু একটা করো।’ বলে নির্দেশ দেন।’
জাবেদ আদালতে আরও বলে, ‘৫ এপ্রিল পরিকল্পনায় বসি আমরা পাঁচজন। বৈঠকের শুরুতেই শামীম নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার প্রস্তাব দেয়। সে হত্যার জন্য দুটি কারণ আমাদের সামনে নিয়ে আসে। একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা করে নুসরাত আলেম সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। অন্যটি হচ্ছে নুসরাত তার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। ওই বৈঠকে কীভাবে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে সেটাও শামীম আামাদেরকে জানিয়েছিল। তারপর আলোচনায় নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।’
জাবেদ বলেন, ‘পরিকল্পনা কার্যকর করতে আমাদের ওস্তাদের ভাগনি ও নুসরাতে বান্ধবী উম্মে সুলতানা পপি ও কামরুন নাহার মনিকে যুক্ত করি। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত মোতাবেক মাদ্রাসার আরও তিন শিক্ষার্থীকে বিষয়টি অবহিত করি আমরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী পপিকে শামীম দায়িত্ব দেয় পুরুষদের জন্য তিনটি বোরকা কিনতে। সেই জন্য দুই হাজার টাকাও দেয় শামীম। পপি বোরকা কেনার জন্য ওই টাকা দেয় মনিকে।
মণি ওই টাকা তিনটি বোরকা ও তিন জোড়া হাত মোজা কিনে শামীমকে দেয়। শামীমের কেরোসিন জোগাড়ের দায়িত্ব নেয়। ঘটনার দিন নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করার স্থান সেই সাইক্লোন সেন্টারে মণি, শামীমসহ পাঁচজন কেরোসিন ও বোরকা নিয়ে চলে যাই। আলিম পরীক্ষা থাকায় ছাদে দুটি টয়লেটে আমরা লুকিয়ে ছিলাম। পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পপিকে দিয়ে নুসরাতকে বলানো হয় ছাদে কারা যেন তার বান্ধবী নিশাতকে মারধর করছে।
এই খবরে নুসরাত পপির সঙ্গে দৌড়ে ছাদে আসলে শামীমসহ বোরকা পরা আমরা চারজন নুসরাতকে ঘিরে ধরি। এসময় তাকে ওস্তাদের ( অধ্যক্ষের) বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে বলি। নুসরাত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তারই ওড়না দিয়ে মণি ও পপিকে দিয়ে আমরা তার হাত বেঁধে ফেলার চেষ্টা করি। শামীমসহ আমরাও এ কাজে যোগ দেই। এ সময় মণি নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়। পরে হাত বাঁধা অবস্থায় আমরা তার শরীরে আগুন লাগিয়ে দ্রুত নিচে নেমে অন্যদের সঙ্গে মিশে যাই।’
অপরদিকে কামরুন নাহার মণি দায় স্বীকার করে বলেন, ‘ঘটনার সময় সে নুসরাত জাহান রাফিকে শোয়া অবস্থায় বুক চেপে ধরেছিলেন। যাতে নুসরাত কোনও নড়াচড়া করতে না পারেন।’
মণি আরও বলেন, ‘শামীমসহ পরিকল্পনাকারীদের সিদ্ধান্তের কথা আমাকে প্রথমে পপি জানিয়েছিলো। পরে আমি তাদের সঙ্গে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যায় জড়িত হই। পপির দেওয়া টাকায় বোরকা ও মোজা কিনে শামীমের কাছে দিয়েছিলাম। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আলিম পরীক্ষার আগে তাদের সঙ্গে আমি সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে যাই। কখন নুসরাতকে পুড়িয়ে পরীক্ষা হলে ফিরবো সেই চিন্তায় উদগ্রীব ছিলাম পুরোটা সময়।
প্রসঙ্গত, নুসরাত জাহান রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিমের পরীক্ষার্থী ছিলেন। ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে এর আগেও ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এসময় তাকে কৌশলে একটি বহুতল ভবনে ডেকে নিয়ে যায় অধ্যক্ষের ভাগ্নি পপি। সেখানে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।