১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধকালীন নরসিংদীর মাধবদীতে নুরালাপুর ইউনিয়নে আলগী গ্রামে পরিত্যক্ত তারিনী বাবুর ভূইয়া বাড়িতে ছিল মুক্তি বাহিনীর আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যুদ্ধ চলাকালীন আজকের এই দিনে (১৬ অক্টোবর) পাক হানাদার বাহিনী ওই বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সেখানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা তাইজ উদ্দিন পাঠান, আনোয়ার হোসেন, সিরাজ মিয়া, আওলাদ হোসেন, মোহাম্মদ আলী ও আঃ সালাম মিয়া একটি কাঁঠাল গাছে বেঁধে গুলি করে ও বেয়নেটের আঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ৬জন শহীদ মুক্তিয়োদ্ধাদের দিনকে ঘিরে স্থানীয় মুক্তিয়োদ্ধারে দাবি তরুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও তারিনী ভূইয়া বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করা অতি জরুরী। এই তারিনী বাবুর ভূইয়া বাড়ির স্মৃতিবিজড়িত চিহ্ন সরূপ পুরনো ভবন গুলো গুড়িয়ে না দিয়ে সরকার যেন পুনসংস্কার করে এই আহ্বান জানান ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও সুশিল সমাজের লোকজন।
সরজমিনে ওই পুরনো বাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় শত শতাংশের উপরে জমি পরিত্যক্ত পরে আছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ^,একটি হাসপাতাল, এর মাঝে পুরনো দুটি ভবন ও নবনির্মিত মুক্তিযোদ্ধারে একটি স্বপ্নের কার্যালয়। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অফিস হিসেবে ব্যবহার করছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
কথা হয় নুরাপুর ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল চৌধুরীর সাথে তিনি নরসিংদী প্রতিদিনকে জানান, সরকার যেন তারিনী বাবু ভূইয়াবাড়ির চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করে দৃষ্টিনন্দন ও একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ করে বহুদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছে এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধারা। গত মাসের ২৭ সেপ্টেম্বর নরসিংদী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধারে একটি অফিসকক্ষ নির্মাণ করে দেয়া হয়। এখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ ও পুরনো বাড়িটি যেন পুনসংস্কার কওে, পুরনো ওই ভবনটি জাদুঘরে পরিনত করা হয় সরকারের কাছে আহ্ববা জানান তিনি।
বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডার ফোরাম ৭১ নরসিংদী জেলা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালিব পাঠান নরসিংদী প্রতিদিনকে জানান, আলগী তারিনী বাবুর ভূইয়া বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা, জমির পরিমাণ সংরক্ষিত করে প্রাচীর নির্মাণের জন্য নরসিংদীর মান্যবর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ওই পুরনো বাড়ির ঐতিহ্য গুড়িয়ে না দিয়ে পুনসংস্কার ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার নির্মাণের দাবি পূর্বে থেকে জানিয়েছেন তিনি।
তারিনী বাবুর ভূইয়া বাড়ির ইতিহাস:
বিভিন্ন বই পুস্তক থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে বর্তমান নরসিংদী সদর উপজেলার নুরালাপুর ইউনিয়নের আলগী গ্রামকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ও আশপাশে বসতি গড়ে উঠে। এ এলাকায় মহেশ্বরদী পরগনার অধীনে ছিল-যা দীর্ঘদিন ঈশা খাঁ ও মোগলরা রাজত্ব করতেন। ওই সময় আলগী গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন তারিনী বাবুর পূর্ব-পরুষ যার একজনের সম্ভবত নাম বানেশ্বর। তারিনী বাবু ভূইয়ারা তিন ভাই ছিলেন আশ্বিনী কুমার ভূইয়া ও সতীশ ভূইয়া। ১৯৫০ সালে পূর্বে তৎকালীন সময়ে প্রচুর ধনদৌলত ও জমি-জমার মালিক ছিলেন তারা। তাই নামের শেষে তালুকদার ও ভূইয়া নাম সংযুক্ত থাকতো।
সতীশ ভূইয়ার প্রকৃত নাম ছিল সতী প্রসন্ন ভৌমিক, তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ে এম,এ, বি, এল পাশ। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি ও শানা-মাকুর পাইকারী ব্যবসা করতেন। এছাড়া ঢাকা ও ভারতে ব্যবস ছিল। তারিনী ভূইয়ার দুই ভাই ব্যবসায় উদ্দেশ্যে দূরদূরান্তে থাকতেন। তাদের অর্থ সম্পদে ঘেরা অট্টালিকায় মাত্র দুই তিনজন পাহাদার ছিলো।
হঠাৎ একদিন রাতে একই উপজেলার কাঠালিয়া গ্রামের ডাকাত সর্দার হিন্দু যুবক হোমা দাস তার তিন সহকর্মী ডাকাতকে নিয়ে পাকড়াও করে তারিনী ভূইয়া বাবুর বাড়ী। এতে তারুনী ভূইয়ার বসত ঘরে ঢুকে ডাকাত দল। তাদের দুজনের হাতে ছিলো শক্ত লাঠি আর অপরজনের হাতে বন্দুক। তারিনী বাবু তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠেন- ‘মান কচুর ড্যাগা নিয়ে মারতে আইছস’? কথা শুনে বন্দুক হাতে ডাকাত সর্দার তাক করে গুলি ছুড়েন। মূহুর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তানিরী ভূইয়া। ডাকাত দল কেমন অর্থ কড়ি লুট করেছিল জানা যায়নি। তারিনী ভূইয়ার মৃত্যুতে তিনদিন ধরে শোক পালিত হয়।
এছাড়া ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে বেশ কয়েক বার দাঙ্গা হামলা হয় তারনী ভূইয়ার বংশের উপর। সুযোগ বুঝে তারনী ভূইয়ার বংশধররা কিছু জমি জমা হস্তান্তর করেন, আর বেশীর ভাগ জায়গা-জমী ফেলে ভারতে চলে যান। এরপর থেকে নামে বে-নামে দখল হচ্ছে ভূইয়া বাড়ির জমি।