লক্ষন বর্মন, নরসিংদী: গ্রীষ্মের তাপদাহে অতিষ্ট প্রাণ, খুঁজে ফিরে একটু স্বস্তির পরশ। সেই অবস্থায় বাঙ্গি প্রাণে এনে দেয় শান্তি, দূর করে শরীরের ক্লান্তি। গ্রীষ্মের অন্যতম ফলগুলোর মধ্যে বাঙ্গি একটি অন্যতম ফল। আর বাঙ্গি চাষে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছে নরসিংদীর চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও স্বাদে অনন্য হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে। অল্প শ্রম ও সল্প খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় প্রতি বছরই চরাঞ্চলে বাড়ছে বাঙ্গির আবাদ। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মৌসুমী কর্মসংস্থানের। তবে অতি বৃষ্টির কারনে চলতি বছর ফলনে কিছুটা ভাটা নেমেছে।
দেশের বেশীরভাগ চরাঞ্চলেই বাঙ্গি উৎপন্ন হয়। পলি, পলি দো আশ ও বেলে দো আশ প্রভূতি মাটি বাঙ্গি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাঙ্গি আকারে বেশ বড় হয়। কাঁচা ফল সবুজ, পাকলে হলুদ রঙের হয়। একটু বেশি পেকে গেলে বাঙ্গি সহজে ফেটে যায়। ফলের বাইরের দিকটা মিষ্টি কুমড়ার মত হালকা ডোরা কাটা খাঁজযুক্ত। খেতে তেমন মিষ্টি নয়, বেলে বেলে ধরনের। এর ভেতরটা ফাঁপা থাকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবছর ৪২ হেক্টর জমিতে বাঙ্গি’র চাষ করা হয়েছে। পলি, পলি দো আশ ও বেলে দো আশ প্রভৃতি মাটি বাঙ্গি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আর নরসিংদীর ৮টি উপজেলার চরাঞ্চল গুলোতে এসব মাটি রয়েছে বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে। সে কারনেই এখানকার উৎপাদিত বাঙ্গি আকারে বেশ বড় হয়। চরাঞ্চলের বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও স্বাদে অনন্য হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নরসিংদীর চরাঞ্চল মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে বাঁশগাড়ি ও পাড়াতলী ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল চর। বিস্তৃর্ণ চরের ধান ও মসলা জাতীয় ফসলের পাশাপাশি বাঙ্গি চাষ করা হয়েছে। মাটির উপর ছড়িয়ে রয়েছে বাঙ্গিগাছের সবুজ লতা। লতার ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা-পাকা বাঙ্গি শোভা পাচ্ছে। জমি থেকেই বাঙ্গি কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারীরা এখানে আসেন। জমি থেকেই বাঙ্গি কিনতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারী ক্রেতারা কৃষকদের সঙ্গে দরদাম করছেন। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কে চলেছে বেচাকেনা।
বাঁশগাড়ি গ্রামের কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘আগে নিজেরা খাওনের জন্য চরে অল্প জমিতে ভাঙ্গি করতাম। কিন্তু গত কয় বছর ধইর্যা বিভিন্ন জায়গার পাইকাররা চর থাইক্যা বাঙ্গি কিনা শুরু করে। গিরস্থরা ভালা লাভ পাওয়ায় বাঙ্গির জমি বাড়তেছে। এখনতো চরের অর্ধেক জমিতেই বাঙ্গি করা হয়।’
বাঙ্গি চাষি ফজলুর রহমান বলেন, ‘বাঙ্গি চাষ করতে তেমন খরচ লাগে না। রসুন ও বাঙ্গি দুই ফসল একবারে করি। রসুনের জন্য সার দেয়ায় বাঙ্গির জন্য আলাদা করে সার লাগেনা। বীজ ও ঔষুধেই যা খরচ। এ বছর এক বিঘা জমিতে ২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি সব মিলাইয়া ৩৫ হাজার টাকা বেচতে পারমু।’
ঝুড়িতে বাঙ্গি ভয়ে নেয়া বাঁশগাড়ি গ্রামের আমির হোসেন বলেন, বাঙ্গির পুরা মৌসুমে এই গ্রামের কেউ বইস্যা থাহেনা। সবাই কিছু না কিছু করে। জমি থাইক্যা একটা বাঙ্গি ঘাটে নিলে ১০ টাকা পাই। এতে প্রতিদিন আমাদের ৮ থেকে থেকে এক হাজার টাকা মজুরি পড়ে।
বাঙ্গি চাষি জমির আলী মীর বলেন, বাঙ্গি চাষ করতেছি ১৬ থেকে ১৭ বছর যাবৎ তবে বাঙ্গি ফলন এ বছর ভাই ছিল কিন্তু অতি বৃষ্টি কারণে ফলন নষ্ট করে দেয়। সে কারণে আর্থিক দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। যদি অতি বৃষ্টি না হত তাহলে আমরা কৃষকরা অর্ধিক পরিমাণে টাকা উর্পাজন করতে পারতাম।
চরে পাইকারী বাঙ্গি বিক্রি হয় শতক হিসেবে। আকার ভেদে প্রতিশত বাঙ্গি ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকায় পাইকারী বিক্রি হচ্ছে। জমি থেকে বাঙ্গি কিনছিলেন কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরের পাইকারী ফল ব্যবসায়ী জাকির হোসেন ও নরসিংদীর মনির মিয়া। তাঁরা জানায়, বাঁশগাড়ীর বাঙ্গি আকারে বড়, দেখতে সুন্দর ও খেতে সুস্বাধু। এই চরের বাঙ্গি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। চাষী বাঙ্গি বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালের অত্যান্ত সুস্বাধু ও পুষ্টিকর ফল। গ্রীষ্মের সময় শরীর থেকে লবণাক্ত পানি বের হয়ে যায়। এসব পূরণে বাঙ্গি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নরসিংদীতে উৎপাদি বাঙ্গি রাজধানী ঢাকা,সিলেট নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা মেচানো হয়।
কিন্তু যাতায়াতের ভাল ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বাঙ্গি মোকামে তুলতেই ২০ থেকে ৩০ টাকা খরচ লাগে। এতে করে বাঙ্গির দাম বেশী পড়ে যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক লতাফত হোসেন বলেন, নরসিংদীর চরাঞ্চলে বাঙ্গি চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বাঙ্গি চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও ভাল বীজ সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে কৃষি বিভাগের। নরসিংদী পাশাপাশি আগামী বছর স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত ভাল বীজ বিভিন্ন চরের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে।