লক্ষন বর্মন, নরসিংদী প্রতিদিন: আজ নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন হত্যাকান্ডের ৬ বছর পূর্তি । দীর্ঘ এই সময়ে দেশের আলোচিত অনেক হত্যা মামলার বিচার কাজ সম্পূর্ণ হলেও অভিযোগপত্রেই থমকে আছে মেয়র লোকমান হত্যাকান্ডের বিচার। তবে উচ্চ আদালত মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য নির্দেশ দেয়ায় আশায় বুক বাঁধছে নিহতের স্বজন ও নরসিংদীবাসী।
এদিকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নরসিংদীতে পালিত হচ্ছে প্রয়াত পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের ষষ্ঠ মৃত্যু বার্ষিকী। ৫ দিন ব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আজ বুধবার সকাল ৭টায় পৌর কবরস্থানে লোকমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন লোকমান হোসেনের পরিবারের সদস্য, জেলা আওয়ামীলীগ, শহর আওয়ামীলীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
লোকমান হোসেনের রাজনৈতিক হাতেখড়ি ছাত্র রাজনীতি থেকে। ২০০৪ সালে নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন নির্বাচিত হন পৌর চেয়ারম্যান। অবহেলিত নরসিংদীতে উন্নয়নের মাধ্যমে নির্বাচিত হন দেশের শ্রেষ্ঠ মেয়র। এরই ফলশ্রুতিতে ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন লোকমান হোসেন।
২০১১ সালের পহেলা নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র লোকমান হোসেনকে। মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। এ ঘটনায় তাঁর ভাই কামরুজ্জামান কামরুল তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে এক আসামী মোবারক হোসেন মোবা বিদেশে পলাতক। বাকি ১৩ জনের সবাই গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।
পুলিশ প্রায় আট মাস তদন্ত করে ২০১২ সালের ২৪ জুন সালাহউদ্দিনসহ এজাহারভুক্ত ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়। এতে মামলার এজাহারভুক্ত তিন নম্বর আসামি শহর আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্য মোবারক হোসেন মোবা, এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার, তাঁর ছোট ভাই শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম সরকারসহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগপত্রে আশরাফুলকে হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই অভিযোগপত্রের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ২০১২ সালের ২৪ জুলাই নরসিংদীর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে নারাজি আবেদন করেন কামরুল। আদালত পরদিন নারাজি আবেদন খারিজ করেন। পরে ২৮ আগস্ট জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন কামরুল। আদালত ৪ নভেম্বর আপিল আবেদন খারিজ করেন। এরপর তিনি হাইকোর্টে ওই অভিযোগপত্র বাতিল করে সিআইডির মাধ্যমে তদন্তের আবেদন জানান। হাইকোর্ট পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নি¤œ আদালতে এ মামলার বিচারকাজ স্থগিত করেন।
দীর্ঘ শুনানী শেষে চলতি বছরের ৯ মার্চ উচ্চ আদালত মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন। আসামীপক্ষ গত ৮ অক্টোবর এই আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করলে আদালত আগামী ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত বিচার বিভাগীয় তদন্তের কার্যক্রম স্থগিত করেন।
মেয়র লোকমান হোসেনের দুই শিশু সন্তান। মেয়ে মিজতাহূল জান্নাত নাজা এখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। আর ছোট ছেলে শাহজেব সালফী এখন কেজি শ্রেণীর ছাত্র। বেঁড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে শিশু নাজা ও সালফী বাবার অভাব অনুভব করছে। আজও অপেক্ষায় আছে তাদের বাবা ফিরে আসবে। ছোট শিশুরা মা, দাদু ও চাচাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, বাবা কখন ফিরে আসবে। লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলীর চোখের পানিও এখন শুকিয়ে গেছে। স্বামীর স্মৃতিবিজরিত ছবিগুলোই এখন একমাত্র সম্ভল। সেই ছবিগুলো আগলে সন্তানদের স্বামীর গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন। আর অপেক্ষার প্রহর গুণছেন ঘাতকদের বিচারের।
জানতে চাইলে মেয়র লোকমান হোসেনের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলী বলেন, আমার সন্তানরা পিতার অভাব অনুভব করে, আমি অনুভব করি স্বামীর অভাব আর নরসিংদীবাসী অনুভব করে অভিভাবকের অভাব। মেয়র লোকমান হোসেনের অভাব কোন দিন পূরণ হওয়ার নয়। তবুও যদি মেয়রের হত্যাকারীদের ফাঁসি হতো তবে সেই অভাবের দুঃখ কিছুটা মোচন হতো। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট এখনো চেঁয়ে আছি, তিনি আমাদের ন্যায় বিচার উপহার দিবেন।
এইদিকে পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ সাধারণ মানুষ। জনবন্ধু কল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক মিঠুন সাহা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলার আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে গ্রেপ্তার করে এনে বিচারকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আর নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যাকারী মোবারক হোসেন এখনো বিদেশে থেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে, যা খুবই দুঃখজনক। নরসিংদীবাসীর একটাই চাওয়া, মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যাকারীদের বিচার। এই ক্ষেত্রে সরকারকে আরও উদ্যোগী হওয়ায় অনুরোধ জানান তিনি।
মামলার বাদী নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, আমাদের প্রাথমিক চাওয়া ছিল, পুলিশ যে অভিযোগপত্র দিয়েছে তার পুণরায় তদন্ত হোক। জুডিশিয়াল তদন্তের মাধ্যমে আমাদের সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা চিহ্নিত হবে। যাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি, তাঁরা এবং তাদের বাইরে যারা এই হত্যা জড়িত সেগুলো বেড়িয়ে আসবে। এবং অবশ্যয় তারা অপরাধের শাস্তি পাবে।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবি এ্যাডভোকেট আসাদ আলী বলেন, আসামী পক্ষের আবেদন খারিজ হয়ে শ্রীঘ্রই বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হবে। তদন্তে বিচারক পুণরায় স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। আমাদের প্রত্যাশা এর মাধ্যমে প্রকৃত আসামীরা অভিযোগপত্রে অর্ন্তভুক্ত হবে।
এদিকে মেয়র লোকমান হোসেনের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ৫ দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে জেলা ও শহর আওয়ামী লীগ, জেলা ছাত্রলীগ এবং জনবন্ধু লোকমান হোসেন ফাউন্ডেশন। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আজ বুধবার সকাল ৭টায় পৌর কবরস্থানে লোকমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নরসিংদী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূইয়া, নরসিংদী পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল, মাধবদী পৌরসভার মেয়র মোশাররফ হোসেন প্রধান মানিকসহ লোকমান হোসেনের পরিবারের সদস্য, জেলা আওয়ামীলীগ, শহর আওয়ামীলীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
পরে মিলাদ, দোয়া ও গণভোজ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে মিলাদ মাহফিল দোয়া ও গণভোজ এবং মসজিদ-মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচী নেয়া হয়েছে।