লক্ষন বর্মন, নরসিংদী প্রতিদিন: নরসিংদীর রায়পুরায় টেঁটাযুদ্ধে সামিল না হওয়ায় চরমধুয়া বাজার ও গ্রামবাসীর উপর হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে ১৫ জন। বাঁশগাড়ি, নিলক্ষ্যা, চরমধুয়ায় ও মির্জারচরে ইউনিয়নে ঘটে এ সংর্ঘষের ঘটনা। রায়পুরার চরাঞ্চলের আলোচিত এ দুটি গ্রুপের টেঁটাযুদ্ধে সামিল না হওয়ায় গ্রাম্য বাজার ও বাড়ি-ঘরে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত থেমে থেমে চলে এ সংর্ঘষ। আওয়ামীলীগ নেতা ও বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজুল হক বাহিনীর সাথে সাবেক চেয়াম্যান ও বাশগাড়ী ইউপি আ’লীগ সভাপতি শাহেদ সরকার বাহিনীর মধ্যে চলে আসা শত্রুতার রেশ ধরে সংর্ঘষ ছড়িয়ে পড়ে পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে। ভাংচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে কমবেশী ৫শতাধিক বাড়িঘর ও দোকানে। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ও পাল্টা হামলা সংঘটিত হয়েছে মির্জারচর ও চরমধুয়া ইউনিয়নে। এতে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রামবাসী।
চরমধুয়া নতুন বাজারের ১০টি দোকানে অগ্নি সংযোগ সহ প্রায় ৪০টি দোকানে হামলা সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষ বাঁশগাড়ী, চরমধুয়া ও মির্জারচর সহ নীলক্ষ্যা ইউনিয়েনে ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাশগাড়ীর এযুদ্ধে পাশ্ববর্তী গ্রামগুলির লোকজন সমর্থন ও সামিল না হওয়ায় রাত ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ওই গ্রামগুলিতেও চলে হামলা। এতে চারটি গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক বাড়ি ঘরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
প্রায় ১০দিন আগে স্থানীয়ভাবে রায়পুরার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজুল হক ও সাবেক চেয়ারম্যান শাহেদ সরকার বাহিনীর মধ্যে মীমাংশা করা হয়। সেই মীমাংসার পরও তারা শনিবার রাতেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেই সংঘর্ষে একটি পক্ষ পার্শবর্তী ইউনিয়ন নীলক্ষ্যা থেকে লোক ভাড়া করে এনে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সময় যাতায়াতের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা হয় চরমধুয়া ও মির্জারচর ইউনিয়নকে। হামলাকারীদের আহবানে চরমধুয়া গ্রামবাসী তাদের সাথে লিপ্ত না হওয়ায়। শনিবার রাতে বাজারে ও গ্রামবাসীদের উপর তারা নগ্ন হামলা চালায়। এই হামলায় প্রায় অর্ধশত বাড়ি থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, টিভি, ফ্রিজ ও ফ্যান নিয়ে যায়। এসময় তাদের হামলায় ৩জন আহত হয়।
গ্রাামবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত শনিবার রাতে প্রথমে বাঁশগাড়ীতে সিরাজুল হক চেয়াারম্যান বাহিনীর সাথে শাহেদ সরকার বাহিনীর টেঁটাযুদ্ধ সংঘঠিত হয়। টেঁটাযুদ্ধে মির্জারচর ও চরমধুয়ার গ্রামবাসীকে আহবান জানানো হয়। কিন্তু চরমধুয়ার মানুষ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। ওই টেঁটাযুদ্ধ সমর্থন ও অংশগ্রহণ না করায উত্তেজিত হয়ে শাহেদ সরকারের পক্ষের লোকজন যুদ্ধশেষে চরমধুয়ায় শিকদার বাড়ি এলাকায় হামলা ও লুটপাট চালায়। এসময় তারা প্রায় অর্ধশতাধিক বাড়ি সহ গ্রাম্য বাজারের প্রায় ৪০টি দোকানের মালামাল ও নগদ অর্থ লুট করে এবং আরো ১০টি দোকান লুটপাট শেষে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এসময় নারীরাও রেহাই পায়নি। সন্ত্রাসীরা অসহায় নারীদের কান ছিড়ে ও গলাথেকে স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে।
এই ঘটনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোর্শেদা শিকদার বারবার রায়পুরা থানা পুলিশকে অবহিত করলেও পুলিশ কোন ভূমিকা নেয়নি বলে সাংবাদিকদের জানিযেছেন তিনি। তিনি আরো জানান, আমি রায়পুরার এএসপি সার্কেলকে সারাদিন বহুবার কল দিয়েও গ্রামবাসীকে বাঁচাতে পুলিশ আনতে পারিনি। ঘটনা ঘটার পরে বিকেল ৫টায় পুলিশ আসে। মূলত, বাঁশগাড়ী, নীলা, চরমধুয়া ও মির্জারচরে কিছু লোক এই হামলার সাথে জড়িত।
চরমধুয়া গ্রামের বাসিন্দা আহসান সিকদার জানান, কিছুদিন আগে স্থানীয়ভাবে রায়পুরার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সিরাজুল হক ও সাবেক চেয়ারম্যান শাহেদ সরকার বাহিনীর মধ্যে মীমাংশা করা হয়। সেই মীমাংশা করার পরও তারা শনিবার বিকেলে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সেই সংঘর্ষে একটি পক্ষ পার্শবর্তী ইউনিয়ন নীলক্ষ্যা থেকে লোক ভাড়া করে এনে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সময় যাতায়াতের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করা হয় চরমধুয়া ইউনিয়নকে। হামলাকারীদের আহবানে চরমধুয়া গ্রামবাসী তাদের সাথে লিপ্ত না হওয়ায়। শনিবার রাতে বাজারে ও গ্রামবাসীদের উপর তারা নগ্ন হামলা চালায়। এই হামলায় প্রায় অর্ধশত বাড়ি থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, টিভি, ফ্রিজ ও ফ্যান নিয়ে যায়। এসময় তাদের হামলায় ৩জন আহত হয়। আমার নিজের গরুর ফার্ম থেকে ৪০টি গরু তারা লুট করে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে আমাদের গ্রামের প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে।
চরমধুয়া নতুন বাজারের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, শনিবার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত শত শত লোক হৈ চৈ করে বাজারের দিকে আসতে থাকে। হঠাৎ করে ককটেল ও গুলির আওয়াজ শোনা যায়। পরে বাজারে মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আমাদের বাজারের সবগুলি দোকানে হামলা চালায়। সেসময় তারা প্রত্যেকটি দোকানের মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। আমার দোকান থেকে প্রায় ১২ লক্ষ টাকার মালামাল নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় প্রায় ১০টি দোকানে তারা অগ্নিসংযোগ করে।
ব্যবসায়ী রুবেল বলেন, আমার ইলেক্ট্রনিক্স এর দোকান থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী লুট হয়। লুট করার পর আমার দোকান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। সবকিছু হারিয়ে আমি এখন দিশেহারা। কি করব বুঝতে পারছি না। আমরা এখন আতঙ্কের মাঝে দিন যাপন করছি। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
চরমধুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল সালাম সিকদার বলেন, তারা সবসময়ই সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে আসছে। আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখতে তারা বিভিন্ন সময় এই ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে এর সমাধানের চেষ্টা করার পরও এই সংঘর্ষ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। সরকারের প্রতি আমি এর সুষ্ঠু সমাধানের আবেদন করছি।
এদিকে শনিবার দুপুর থেকে শুরু হয়ে রোববার গভীর রাত পর্যন্ত চলে উভয় পরে হামলা ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। মির্জারচর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া ও বালুচর গ্রামে তিন শতাধিক বাড়িঘরে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলা চলাকালে উভয় পে কমবেশি ১০ ব্যক্তি আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ইকবাল (৩০) ও রজব আলী (২৮) নামে ২ জনকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এদের দুই জনই পরাজিত চেয়ারম্যান ফারুকুল ইসলাম সমর্থক বলে জানা গেছে। ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিকান্ডে তিগ্রস্থ কমবেশি ২শত পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। তারা এখন চরাঞ্চলের খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী জাফর ইকবাল মানিক ও ফারুকুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে দ্বন্দ্ব-কলহ চলে আসছে। নির্বাচনী এই বৈরীতাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই মির্জারচরে ছোটবড় কমবেশী ৪টি সংর্ঘষ হয়েছে। উভয় পরে বিররুদ্ধে রায়পুরা থানায় মামলা হয়েছে কমবেশি ৯টি। সর্বশেষ সংঘর্ষ হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর। সেদিনের সংঘর্ষে আহত হয় প্রায় ১০ জন। এর মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় পরাজিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ফারুকুল ইসলাম ও তার সহযোগী অপু। এই ঘটনার পর থেকে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
গত শনিবার দুপুরে ফারুকের সমর্থকরা জনৈক মাঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান মানিকের সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে ৪২টি বাড়িঘর তিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার পর চেয়ারম্যান মানিকের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা পার্শবর্তী ইউনিয়ন বাশগাড়ী, চরমধুয়া, নিলা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া নবীনগর উপজেলার চরলাপাং থেকে কয়েকশত লাঠিয়াল ভাড়া করে এনে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মির্জারচর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া ও বালুচর গ্রামে হামলা চালায়। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টাব্যাপী হামলা চলাকালে চেয়ারম্যান সমর্থক লাঠিয়াল বাহিনী তান্ডব চালিয়ে কমবেশি ৩ শতাধিক বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
এব্যাপারে চেয়ারম্যান মানিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, যে ফারুকের সমর্থকরা বিনা উস্কানীতে শনিবার দুপুরে তার সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ৪২টি বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্তি হয়ে গ্রামবাসীরা ফারুকের লাঠিয়ালদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে দুইপে সংঘর্ষ হয়। খবর পেয়ে নরসিংদী থেকে দাঙ্গা পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে লাঠিয়ালরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সোমবারও সেখানে ব্যাপক সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ নেতা সাহেদ সরকার ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হক’র সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। এই ঘটনা নিয়ে কিছুদিন পূর্বে সাহেদ সরকার ফেফতার হয়ে মাসাধিককাল কারাভোগ করে মুক্তি পায়। গত শনিবার রাতে মাঈন উদ্দিন নামে তার এক সমর্থকের বাড়িতে বসে সাহেদ সরকারের লাঠিয়ালরা গোপন সভা করছিল। এ সময় তাদের একটি গ্রুপ অপপ্রচার চালায় যে, মাঈন উদ্দিনের বাড়িঘর সিরাজুল হকের সমর্থকরা ঘিরে ফেলেছে, যেকোন সময়ই হামলা হতে পারে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাত ৮টা থেকে সাহেদ সরকারের সমর্থকরা বটতলিকান্দী, বালুয়াকান্দী, চরমেঘনা ও দিঘলিয়াকান্দী ও নতুনবাজার এলাকায় ব্যাপকভাবে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে। এসময় এলাকায় ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। এই সুযোগ নিয়ে সাহেদ সরকারের লাঠিয়ালরা উলেখিত গ্রামগুলোতে সিরাজুল হকের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে প্রায় অর্ধশত বাড়ি এবং ৫টি দোকান ভাংচুর ও লুটপাট করে।
রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দেলোয়ার হোসেনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনা তেমন কিছু না। সামান্য ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার রাত ১০টার দিকে দুই একটা দোকান ভাংচুরের খবর আমরা পেয়েছি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছে। আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ শফিউর রহমান বলেন, চরমধুয়া গ্রামে সহিংসতা এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এবং এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতারের অভিযান চলছে। এছাড়া তিনি আরো বলেন, এই টেটা যুদ্ধের নেপথ্যে যারা রয়েছেন তাদেরকে একাধিকবার গ্রেফতার করলেও তারা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। জামিনের পর আবারো শুরু হয় তাদের সেই অধিপত্য বিস্তারের টেটা যুদ্ধ। যার কারণে এই টেটা যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।