নরসিংদী প্রতিদিন: নরসিংদীর রায়পুরায় প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। গ্রন্থাগারে কিছু বই থাকলেও জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতিচিহ্ন নেই। অবহেলায় পড়ে আছে- তার পৈত্রিক ভিটেবাড়ি।
একই সঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠের নামে তাদের গ্রামের নামকরণের সরকারি সিদ্ধান্তও আটকে আছে কাগজ-কলমে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগরে গিয়ে নিশ্চিহ্ন স্মৃতিচিহ্ন দেখে হতাশ হতে হচ্ছে।
রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম রামনগর। প্রবাহমান মেঘনার গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা গ্রামটি চারপাশের অন্য গ্রামের চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাহমুদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতিফলক ‘বাংলার ঈগল’। ত্রিমুখী কালো পাথরের স্তম্ভ। এর একটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রতিকৃতি, আরেকটি জীবনবৃত্তান্ত। অপর স্তম্ভটিকে খোলা আকাশের প্রতীক হিসেবে ফাঁকা রাখা হয়েছে। মাঝে ত্রিভুজ আকৃতির স্মম্ভে টেরাকুটায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য ফুটে উঠেছে। সবার ওপরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর গ্রামের প্রবেশ নির্দেশক।
সেই পথ ধরে গ্রামে প্রবেশ। কিছু দূর এগুলোই পড়ে ৪ রাস্তার মোড়। পাশের দোকানে নামফলকে লেখা রামনগর বড় মসজিদ মোড়। সেই মোড়ে আলাপচারিতায় মগ্ন ৩ বৃদ্ধ। তাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ভূঞা। তিনি রামনগর পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রসঙ্গ তুলতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ভূঞা।
তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান গ্রামে ছিলেন। তিনি স্থানীয় রামনগর দক্ষিণপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। এখানেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানি বিমান ছিনতাইয়ের ছক কষেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানে গিয়ে বিমান ছিনতাই করার সময় বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হন তিনি।
তিনি দুঃখ করে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠের নামে গ্রামের নামকরণের সরকারি সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি পোস্ট অফিসের সিলমোহরে রামনগরের নাম পরিবর্তন করে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর লিখতে পারছি না।
পাশেই রামনগর হাইস্কুল এবং রামনগর উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলগুলোর মাঠের একপাশে ২০০৮ সালে নির্মাণ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। জেলা পরিষদ গ্রন্থাগারটি তত্ত্বাবধান করছেন।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। পাঠাগারে কিছু বই থাকলেও জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। দুই বছর ধরে শুধু তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। লাইব্রেরিয়ানের পদটি ২ বছর ধরে শূন্য। ফলে অযত্ন-অবহেলায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি।
জাদুঘরের সামনে কথা হয় কলেজছাত্র আসিফ কাজী ও বিজয় কাজীর সঙ্গে। তারা জানায়, উদ্বোধনের পর দীর্ঘ ৯ বছরে লাইব্রেরিতে নতুন করে বই দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে পরিচর্যার অভাবে জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদন হারাচ্ছে।
জানতে চাইলে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক এনামুল হক বলেন, দুজনের কাজ একজন করলে যেমন হয় সেভাবেই প্রতিষ্ঠানটি চলছে। বছরের অধিকাংশ দিনই দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আগ্রহ নিয়ে লোকজন আসে কিন্তু জাদুঘরে কোনো সংগ্রহশালা না থাকায় তারা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিতে সম্প্রতি বখাটেদের উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বাড়িতে কেউ থাকেন না। ফলে দরজায় ঝুলছে তালা। বাড়ির সামনে নতুন করে লাগানো হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান যুব সংঘের সাইনবোর্ড। চারপাশের বাড়িগুলোতে থাকে বীরশ্রেষ্ঠের স্বজনরা।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক সৈকত ভূঞা বলেন, সরকার বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামের নামকরণটি এখনো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেনি। একটি সাইনবোর্ড ছাড়া গ্রামের অন্য কোথাও এর প্রতিফলন নেই। একই সঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ব্যবহার সামগ্রী না থাকায় জাদুঘরের স্বার্থকতা আসেনি।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান বলেন, যত দিন পর্যন্ত ইউনিয়ন, ডাকঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম না বদলানো হবে তত দিন পর্যন্ত বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর নামটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব হয়ে থাকবে। এটা বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। এই ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবারের পক্ষ থেকে ওনার স্মৃতিকর্ম দিয়ে সহযোগিতা করা হবে।
এই ব্যাপারে রায়পুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিজয় দিবসে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। একই সঙ্গে শিগগিরই বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।