নরসিংদী প্রতিদিন ডেস্ক, মঙ্গলবার, ০৬ মার্চ ২০১৮:
কর্মস্থলে, চলার পথে সর্বদা সর্বত্র যৌন হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে নারীদের। এই প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই প্রতিদিন পথ চলতে হয় তাদের। প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, গণপরিবহণে ৯৪ শতাংশ নারী কোনও না কোনও সময় যৌন হয়রানির শিকার হন। ৮১ শতাংশ নারী চুপ থাকেন এবং ৭৯ শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে আসেন।
২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাস ব্র্যাকের এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে নগর, উপনগর ও গ্রামাঞ্চলের ৪১৫ জন নারী তাদের অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেছেন। সেই আলোকেই মঙ্গলবার (৬ মার্চ) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ব্র্যাক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সময়ের সাথে সাথে নারীরা আজ আরও অধিক সংখ্যায় প্রতিদিন ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন এবং রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনে পুরুষের পাশাপাশি ভ্রমণ করছেন। তারপরও যৌন হয়রানির ঝুঁকি তাদের হ্রাস পায়নি। প্রতিদিনই হয়রানির ঝুঁকি নিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হচ্ছে।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, সড়কে হাঁটাচলার চেয়ে গণপরিবহণে যৌন হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটছে। সড়কে হাঁটাচলার সময় নারীদের মৌখিক হয়রানি হতে হয়। তাদের দিকে তাকিয়ে সেক্সি, হট ইত্যাদি খিস্তিখেউর করা হয়। তাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় শিস দেয়া, চুম্বন বা অশালীন শব্দ ব্যবহার; ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে মোবাইল নম্বর, ফেসবুক, টুইটারের ঠিকানা চাওয়া; পীড়নমূলক ভাষা প্রয়োগ করে তাদের সাথে কথা বলা; তাদের পোশাক দৈহিক বৈশিষ্ট্য বা চেহারা নিয়ে খারাপ মন্তব্য করা; তাদের বান্ধবী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া, যৌন জীবন নিয়ে প্রশ্ন করা বা যৌন সম্পর্ক স্পর্শ করার চেষ্টা করা হয়।
সড়কে মোখিক হয়রানি হলেও গণপরিবহনে শারীরিক হয়রানি হতে হয় নারীদের। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, কাছে ঘেঁষে দাঁড়ানো, আস্তে ধাক্কা দেওয়া, নারীদের চুল স্পর্শ করা, কাঁধে হাত রাখা, হাত, বুক বা শরীরের অন্যান্য অংশ দিয়ে নারীর বক্ষস্থল আক্রান্ত করা, নারীর পশ্চাদ্দেশে বা গোপনাঙ্গে স্পর্শ করার চেষ্টা করা হয়।
প্রতিবেদনে গণপরিবহন ব্যবহারকারী উত্তরদাতাদের ৩৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রায় ৫৯ শতাংশ উত্তরদাতা ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী উত্যক্তকারী চিহ্নিত করেছেন। প্রায় ৬৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের। যা কিছুটা হলেও উদ্বেগের বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নারী পথচারীদের মধ্যে ৪২ শতাংশ উত্তরদাদা বলেছেন, তারা ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রায় ৪৬ শতাংশকে যৌন হয়রানি করেছে ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সীরা এবং ৮ শতাং উত্তরদাদা ষাটোর্ধ্বদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। পাঁচ ধরনের বয়সীদের মধ্যে নারী পথচারীদের জন্য সবচেয়ে বিপদজ্জনক হিসিবে চিহ্নিত হয়েছে ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী যৌন হয়রানিকারীরা।
‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ব্র্যাক। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন- ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হোসনে আরা বেগম ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) রির্সাচ অ্যাসোসিয়েট কবিতা চৌধুরী।
গবেষণা পরিচালনা করেছেন অধ্যাপক সৈয়দ সাদ আন্দালিব, অধ্যাপক সিমিন মাহমুদ, ফাহমিদা সাদিয়া রহমান এবং কবিতা চৌধুরী।
গণপরিবহনে নারী নির্যাতনে কারণ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলো না থাকা, তদারকি অভাবে নারীদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে।
গবেষণার ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে তিনটি কৌশলগত দিকের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। সামর্থ্য বৃদ্ধি, সর্বস্তরের জনসচেতনতা ও জনগনকে সংগঠিত করা এবং নীতিগত পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি।
ব্রাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির ডিরেক্টর আহমেদ নাজমুল হুসেইন বলেন, ‘টেকসই উন্নত লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) নারীর জন্য নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য এসডিজি বাস্তবায়নে যোন হয়রানিমুক্ত সড়ক ব্যবস্থা রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন- ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সৈয়দ সাদ আন্দালীব, ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির প্রোগ্রাম হেড হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, নারীদের শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও কর্মক্ষেত্রে এখনও তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই গবেষণা সুপারিশের ভিত্তিতে তারা এ ব্যাপারে জনসচেতনতা পাশাপাশি আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের ওপর জোর দাবি জানান।