শরীফ ইকবাল রাসেল ও খন্দকার শাহিন*
নরসিংদী প্রতিদিন,সোমবার,২৬ মার্চ ২০১৮: ৭১’র রণাঙ্গনের যুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধে আজ পরাজিত মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া। ১৯৭১ সালে ২২ বছর বয়সে দেশমাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আজ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর পথযাত্রী হয়ে নরসিংদীর পলাশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন মুক্তিযুদ্ধা লাল মিয়া দেখার কেউ নেই।
মুক্তিযোদ্ধা সনদ অনুযায়ী তারঁ সনদ নম্বর ম.১৪০৪৪০, তারিখ ২২.১০.২০০৯ আইডি নম্বর ০৭০৩১০০৩৪৯ গেজেট ৩৬০৭ তারিখ ২৪.১১.২০০৫। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে লাল মিয়া জীবিকার টানে নরসিংদীর শিল্পাঞ্চল খ্যাত পলাশ উপজেলায় চলে আসেন। বর্তমানে পলাশে অসুস্থ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন।
লাল মিয়া সাংবাদিকদের জানান তার জীবন ও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প। ১৪/১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি তাঁর বাবার সাথে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতেন। ২০ বছর বয়সে চাচার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্বরপুর থানার চাঁন্দার গাঁও গ্রামে বেড়াতে যান তিনি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন এলাকায় যুবকদের আনসার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আনসার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার আগ্রহ জাগে তাঁর মনে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নির্দেশ/নিয়ম অনুযায়ী জন্মস্থানের ঠিকানা দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণে অংশ নেয়া যাবে না। চাচার বাড়ির ঠিকানা দিয়েই আনসার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন টগবগে যুবক লাল মিয়া। সেখানে রাইফেল প্রশিক্ষণও দেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে জীবিকার টানে চাচার বাড়িতে বসবাস করেই কৃষি শ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে পাকিস্তানিরা এদেশে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। অস্ত্র হাতে তুলে নিতে থাকে এদেশের তরুণ, ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিকরা। তখন তেমন কিছু বুঝেন না কৃষি শ্রমিক লাল মিয়া। বুঝেন শুধু এই দেশটা রক্ষা করতে হবে পাকিস্তানীদের হাত থেকে। এরই মধ্যে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা আসে।
২২ বৎসর বয়সী টগবগে যুবক লাল মিয়া দেশ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়। দেশ মাতৃকার টান তাকে অস্থির করে তুলে। আর এই অস্থিরতা তাকে ঘরে থাকতে দেয়নি। বাবা-মা কে না জানিয়েই সুনামগঞ্জের চাচার বাড়ি থেকেই যুদ্ধে চলে যান তিনি। ৫নং সেক্টর কমান্ডার মেজর সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে চীনাকান্দি বিডিআর ক্যাম্পে ফজলুর রহমান, কাসেম আলী, মন্নান, তারাচাঁন, মনসুর আলী, সিরাজ, আলী হোসেন, আঃ আলীম, রশিদ, সাত্তার, ওমর আলী, বাবু, দুলু, বিসম্বর, খালেক, গফুর, বারেক ও সিরাজসহ অন্যান্য সহযোগীদের নিয়ে ক্যাম্পে অবস্থান শুরু করেন আনসার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লাল মিয়া। এখান থেকে ভাতেরটেক, সুরমা নদীর পাড়ে লালপুর, উড়াকান্দা, বেরিগাওঁ, মঙ্গলকাটা, টুকেরঘাট ও শালবন এলাকায় পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধ করেন লাল মিয়া ও তাঁর সহযোগীরা।
যুদ্ধকালীন সময়ে লালপুর গ্রামের সুরমা নদীর পাড়ে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ব্যাপী সংঘটিত সম্মুখ যুদ্ধের স্মৃতি ভুলতে পারেন না তিনি। সেদিন নদীর একপাড়ে লাল মিয়াসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান অপর পাড়ে পাকবাহিনী। পাকবাহিনীকে ধ্বংস করতে প্রাণপন লড়াই চলছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকবাহিনী নদীর ওই পাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হঠাতে বোমা বর্ষণ শুরু করে। বোমাবর্ষণে সেই স্থানে সৃষ্ট বিশাল গর্তে চাপা পড়ে শহীদ হয়েছিলেন দুই সহযোদ্ধা। কমান্ডারের নির্দেশে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে প্রাণে বাঁচেন লাল মিয়াসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা।
দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ৩ মাস সুনামগঞ্জের চাচার বাড়িতে থেকে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি স্বাক্ষরিত সনদ হাতে নিয়ে জন্মভূমি কিশোরগঞ্জে ফিরে আসেন তিনি। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে পরলোকে চলে যাওয়ায় বাবাকে দেখতে পাননি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিয়ের পিড়িতে বসেন মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া। বিয়ের পর হাতে ছিল না তেমন কোন কাজ, অন্যের বাড়িতেও কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। দু:খ দুর্দশার সংসার জীবনে চার সন্তানের জনক হন তিনি।
পরে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে বাম হাত ও বাম পায়ের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এরপর তার জীবন সংগ্রাম কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে তাঁর। বাধ্য হয়ে জীবিকার টানে চলে আসেন নরসিংদীর শিল্পাঞ্চল পলাশ উপজেলায়। এখানে এসেও শারিরীক অক্ষমতার কারনে কোন কাজ জুটেনি তার ভাগ্যে। পাশে নেই কষ্টে লালন পালন করা সন্তানরাও। চার সন্তানের তিনজনই বিয়ে করে সংসার করছে কিন্তু নিজেদের অভাব অনটনের কারনে বাবার খোঁজ নিতে পারেন না তিন সন্তান। এলাকার সচেতন মহলের কাছে হাত বাড়িয়েও কোন ফল পাননি লাল মিয়া। বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয় তাকে। ঘোড়াশাল ইউরিয়া সারকারখানার গেটে বসে চলে তার ভিক্ষাবৃত্তি। কিন্তু দুবছর ধরে গুরুতর অসুস্থ্য থাকার কারনে এখন বিছানায় মৃত্যুপথযাত্রী।
বর্তমানে পলাশ উপজেলার গাবতলী গ্রামে বশির উদ্দিনের বাড়িতে মাসিক এক হাজার টাকা ভাড়ায় একটি মাটির ঘরে বসবাস মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার। শত কষ্টেও ছোট সন্তান রাইজুল ইসলামকে নরসিংদী সরকারী কলেজে প্রাণী বিদ্যুা বিভাগের ছাত্র।
এরই মধ্যে সরকার কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দেয়া শুরু হলে এই তালিকায় নাম উঠে আসে লাল মিয়ার। কিন্তু ভাতা গ্রহণ করতে হয় সুনামগঞ্জ জেলা থেকে। পলাশ থেকে যাতায়াত খরচ হিসেবে চলে যায় ১ হাজারেরও বেশি টাকা। অন্যান্য উপরি খরচ মিটিয়ে শেষ পর্যন্ত তার হাতে ভাতা বাবদ যে টাকা থাকে তা দিয়ে সংসার চলছে না এই মুক্তিযোদ্ধার। কলেজ পড়–য়া ছেলেটির লেখাপড়া শেষ করতে পারলে ছোটখাট একটি চাকরি জুটবে সরকারের প্রতি সেই প্রত্যাশা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন ৭১’ এর এই যোদ্ধা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার ছেলে রাইজুল ইসলাম রাজু জানায়, বাবা যুদ্ধ শেশে দেশের আসার পর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে বাম হাত ও বাম পায়ের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এরপর তার জীবন সংগ্রাম কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে তাঁর। বাধ্য হয়ে জীবিকার টানে চলে আসেন নরসিংদীর শিল্পাঞ্চল পলাশ উপজেলায়। এখানে এসেও শারিরীক অক্ষমতার কারনে কোন কাজ জুটেনি তার ভাগ্যে। পাশে নেই কষ্টে লালন পালন করা সন্তানরাও। বর্তমানে পলাশ উপজেলার গাবতলী গ্রামে বশির উদ্দিনের বাড়িতে মাসিক ভাড়ায় একটি মাটির ঘরে বসবাস করতে হচ্ছে।
পলাশ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহজাহান গাজী জানান, মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া লাল মিয়া আমার বাড়ির পাশেই থাকেন, তিনি সব সময় আমাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন। তিনি খুবই দরিদ্র, বর্তমানে তিনি গুরুতর অসুস্থ্য থাকায় বিছানায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুপথ যাত্রী। তার চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন যা তাদের নেই। তাই সরকার তাঁর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসা দরকার।
পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর ইউ ইচ সি রফিকুল ইসলাম জানান, বীরমুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়া, টিবি রোগে আক্রান্ত, এছাড়া আলসার, শ্বাসকষ্ট, চর্ম, প্যারালাইসিসসহ কিছু গুরুতর রোগে আক্রান্ত। এই সকল বিষয়ে প্রথমে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষার প্রয়োজন। এগুলো ঢাকা থেকে করাতে হবে। আর তাঁর জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন যা লাল মিয়ার পক্ষে সংগ্রহ করার মতো নেই বলে আমি জানি।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভাস্কর দেবনাথ বাপ্পি বলেন, আমি শুনেছি লাল মিয়া নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা হলেও এই এলাকায় তিনি বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরে। শুনেছি তিনি খুবই অসুস্থ্য এবং তাঁর ছেলের লেখাপড়া করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে আমরা পলাশ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁর পরিবারের সকল সমস্যাই সমাধানের চেষ্টা করবো।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানোর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানানোর সরকারকে তিনি ধন্যবাদ জানান। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার চিকিৎসা ও ছেলের লেখাপড়া মেষে একটি চাকরীর পাশাপাশি এই পরিবারের জন্য একটি বাড়ি পাওয়ার আশায় পথ চেয়ে আছেন এই বীর।