নিউজ ডেস্ক,নরসিংদী প্রতিদিন,রবিবার,২ সেপ্টেম্বর ২০১৮:
নাটোরের একডালায় অবস্থিত প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান প্রাণ এগ্রো লিমিটেডের কারখানা। কারখানার দূষিত বর্জ্যে স্থানীয় বিল, জলাশয় ও নদীতে প্রতিবছরই লাগছে মড়ক। নষ্ট হচ্ছে ফসল মারা যাচ্ছে মাছ। এ নিয়ে খোলা কাগজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব আজ
দখল-দূষণে বিলুপ্ত হতে বসেছে নাটোরের প্রাণখ্যাত নারদ নদ। যে কয়টি শিল্পকারখানার বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়েছে নারদ প্রাণ এগ্রো লিমিটেড এর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও যমুনা ডিস্টিলারি, কিষোয়ান এগ্রো ও নাটোর সুগার মিলও রয়েছে দূষণের ভূমিকায়। এ নিয়ে স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা আন্দোলন-সংগ্রাম করে এলেও কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না নারদ দূষণ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এক সময়ের প্রবল স্রোতস্বিনী ও বিস্তৃত নারদ এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। ফলে দূষণের মাত্রাও বেড়ে গেছে। বছরের অন্যান্য সময় পানি প্রবাহ তেমন একটা না থাকলেও বর্ষা মওসুমে এ নদে পানির প্রবাহ বাড়ে। সেই প্রবাহ আষাঢ়-শ্রাবণ থেকে শুরু হয়ে কার্তিক-অগ্রহায়ণ পর্যন্ত থাকে। এ সময় মোটামুটি ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে নারদ নদ। স্থানীয় লোকজন এখানে গোসল সারেন, মাছ ধরেন। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে এ নদ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। এখন নদে নেমে কেউ গোসল করতে পারেন না। পানিতে নামলেই রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য গায়ে লাগলেই চুলকানিসহ নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হন বাসিন্দারা। আগে প্রচুর মাছ পাওয়া গেলেও এখন মাছের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। সারাক্ষণ নারদ নদের পানি দুর্গন্ধ ছড়ায়। নদ দূষণের কারণে মশার উৎপাতও বেড়ে গেছে।
স্থানীয় সচেতন নাগরিক কমিটিসহ (সনাক) বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে নারদ নদ দূষণমুক্তি ও পুনরুদ্ধারের। এ নিয়ে গত বছর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদের বিভিন্ন স্থানে ৩৭টি প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরে।
গত বছরের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সে সভায় নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, প্রাণ এগ্রো, যমুনা ডিস্টিলারি, কিষোয়ান এগ্রো এবং নাটোর সুগার মিলের কারণে নারদ নদ তীব্র দূষণের কবলে পড়েছে। তিনি বলেন, বিষাক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত পানি ফেলে নারদকে মেরে ফেলেছে কোম্পানিগুলো। সভায় প্রাণ এগ্রো লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক হযরত আলী দাবি করেন, বর্জ্য পরিশোধন করে নদীতে ফেলছেন তারা।
জেলা প্রশাসক জানান, প্রাণের এ দাবি অসত্য। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজে পরিদর্শন করে দেখেছি, প্রাণ এগ্রো তাদের ইটিপি (বর্জ্য পরিশোধনাগার) সার্বক্ষণিক চালু রাখে না। যদি চালু থাকতো তাহলে এ সমস্যা হতো না।’ জেলা প্রশাসক সেদিন সেই মুহূর্ত থেকে কোনো বর্জ্য নারদ নদে না ফেলার জন্য নির্দেশ দেন কারখানাগুলোকে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সে নির্দেশ এক বছরের বেশি সময়ও কার্যকর হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তারা বলেছেন, কারখানাগুলো এখনো প্রতিদিন তাদের অপরিশোধিত বর্জ্য ও রাসায়নিক মিশ্রিত গরম তরল পানি ফেলছে নারদে। এসব দেখেও যেন কেউ দেখছে না। প্রাণসহ অন্যান্য কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদ দূষণ অব্যাহত রেখেছে।
নাটোর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রণেন রায় খোলা কাগজকে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখল এবং কলকারখানাগুলোর বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে নারদ নদ আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছি।
কারখানাগুলো বরাবরই আমাদের জানায়, তারা বর্জ্য নদীতে ফেলছে না। কিন্তু ঠিকই স্থাপিত পাইপ দিয়ে গোপনে নদীতে বর্জ্য ফেলছে। তা না হলে নদের পানি থেকে দুর্গন্ধ আসবে কেন? নদের পানিতে নামলে চর্মরোগ হবে কেন? মূলত বর্ষাকালেই দূষণ সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। কারণ বৃষ্টির পানিতে নদের জলপ্রবাহ বেড়ে গিয়ে সর্বত্র দূষণ ছড়িয়ে পড়ে।
অবিলম্বে দূষণ ও নদ দখল বন্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে বরাবরই চাপ দিয়ে এসেছি। কিন্তু সর্বত্র দুর্বৃত্তায়নের কারণে দূষণ ও দখল কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহীনা খাতুন বলেন, দু-তিন মাস আগে আমি নিজে পরিদর্শন করেছি, প্রাণসহ কয়েকটি কারখানা নিজেদের বর্জ্য শোধনাগার করেছে। কিন্তু এ কয়েক মাসে তারা বর্জ্য আবার নদীতে ফেলছে কি না নিশ্চিত নই। প্রয়োজনে শিগগিরই আমরা আবার পরিদর্শনে যাব। যদি দেখি বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।