খন্দকার শাহিন,নরসিংদী প্রতিদিন,শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮: বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান নিজেদের যৌবন কালে বর্ণাঢ্য রাজনীতির সূচনা লগ্নে এক অগ্নিযুগেরও সংগ্রামী এই দুই নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্তে পঁচাত্তর পরবর্তীতে মাসের পর মাস এক সাথে কারাভোগ করে বর্ষীয়ান দুই মন্ত্রী। শনিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ময়মনসিংহের ত্রিশালে মিনিস্টার হাইটেক পার্ক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের নতুন কারখানার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথি ও সভাপতির বক্তব্যে কারা জীবনের অসহনীয় নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন তারা।
ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগকে। ছেলেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়েছেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় সভাপতির নির্দেশে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদকে আসনটি ছেড়ে দেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামের নিরন্তর পথচলা প্রসঙ্গে ধর্মমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এবং তোফায়েল ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই সঙ্গে এমএসসি পাস করেছি। এক সঙ্গে আন্দোলন করেছি। ময়মনসিংহ জেলে আমরা এক সময় অনেকদিন ছিলাম। আমরা সুদিন-দুর্দিনের সাথী। কিন্তু বিরোধী সরকারের কাছে কোনোদিন মাথা নত করি নাই।’
নিজের বক্তৃতার শুরুতেই মতিউর রহমানের উল্লেখ করা কারাভোগের দুঃসহ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদও। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৬ সেপ্টেম্বর আমাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর অনেক নির্যাতন করে এবং ফাঁসির আসামির মতো কনডেম সেলে রাখে। তারপর ময়মনসিংহ কারাগারে মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়।’
তিনি বলেন, ২০ মাস তার (মতিউর রহমান) সঙ্গে ময়মনসিংহ কারগারে বন্দি ছিলাম আমি। সেখান থেকে কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাস থাকার পর মোট ৩৩ মাস পর মুক্তি পেয়েছিলাম। যার সঙ্গে কারাগারে দিন কাটিয়েছি তিনি আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি।
‘আমার স্ত্রী, আমার মা ও আমার ছোট্ট মা-সহ যখন দেখা করতে আসতো, শ্রদ্ধেয় মতি ভাই তার বাসায় আমার পরিবার থাকতো। আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়েও কারা নির্যাতনের বর্ণনা দেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ২০০১ সালের দিকে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। মতিউর রহমানকেও গ্রেফতার করে কাশিমপুর কারাগারে রাখা হয়েছিল।
‘আমাকে গ্রেফতার করে ফাঁসির আসামির মতো যেখানে এরশাদ শিকদারের মতো কুখ্যাত আসামি থাকতো সেই রুমে রাখা হয়। প্রায় ১২ দিন পর হাতকড়া পরিয়ে পরে আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠিয়েছিলো।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের উদাহরণ দিতে গিয়ে নিজের জন্মভিটা ভোলায় ফিরে যান তোফায়েল।
বলেন, ‘ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী সেদিন আমার জন্মস্থান ভোলায় গিয়েছিলেন। সেটা এখন গ্রাম না! ছোট্ট বেলা আমরা খালি পায়ে স্কুলে যেতাম। বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে খাল পার হতাম।’
‘রাস্তাঘাট স্কুল-কালভার্ট কিছুই ছিলো না। আমরা কুপি ও হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তাম। সেই গ্রামে এখন বিদ্যুৎ আছে। মানুষের হাতে মোবাইল ফোন আছে। কারো হাতে চায়ের কাপ আছে। মানুষজন টেলিভিশন সামনে রেখে চা খায়, মোবাইলে টেলিফোন করে। ছোট বেলা ১০০ ঘরের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০টি কাঁচাঘর ছিলো।’
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এখন ১০০টি ঘর, পাকা ও টিনের ঘর-এই হলো আজ বাংলাদেশ। প্রত্যেকের পায়ে জুতা, সুন্দর শার্ট। স্বাস্থ্য ভালো। দরিদ্র্যতা কমে গেছে। আমরা যখন বিদেশে যাই- বলি, আওয়ার কান্ট্রিজ ইজ ভেরি বিউটিফুল। ‘আমাদের দেশ রূপসী বাংলাদেশ। এই রূপসী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিব,’ যোগ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
বর্ণাঢ্য আয়োজনে ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আলী আজগার টগর এমপি, ডা. এম আমানউল্লাহ এমপি, ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল এমপি, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, বিভাগীয় কমিশনার মাহমুদ হাসান, ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝিঁ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও সদস্য রেজাউল হাসান, জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন, মাইওয়ান-মিনিস্টার হাইটেক পার্কের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক রাজ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলরূবা তনু, প্রাইম ব্যাংক লি. এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এন্ড সিইও রাহেল আহমেদ।
মাইওয়ান-মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান এম. এ রাজ্জাক খান রাজ বলেন, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এবং টেকসই পণ্য তৈরী করছে দেশীয় ইলেকট্রনিক ব্রান্ড মিনিস্টার। মিনিস্টারের এই পরিবেশ বান্ধব পণ্যগুলো সাধারন মানুষের জীবনকে করে তুলবে আরো সহজ। একটি সুন্দর আগামীর জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বক্তারা বলেন, দেশের বাজারকে সমৃদ্ধ এবং নিজেদের অবস্থান সুসংহত ও রপ্তানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্র্যান্ড মিনিস্টারের নতুন কারখানার উদ্বোধন করা হয়েছে।
আমার পণ্য আমার দেশ, গড়ব বাংলাদেশ এই শ্লোগানকে লালন করে প্রায় ২০০ বিঘা জমির উপর ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ফ্যাক্টরিটি। কারখানাটিতে প্রতিদিন মিনিস্টার ব্র্যান্ডের প্রায় ১০ হাজার রেফ্রিজারেটর ও এসি’র উৎপাদন হবে। যন্ত্রাংশ তৈরী থেকে শুরু করে সংযোজন সব কাজ এই কারখানাতেই সম্পন্ন হবে।
এতে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশী মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশপাশি কমংসংস্থানও বাড়বে। আপাতত স্থানীয় বাজারে রেফ্রিজারেটর ও এসি সরবরাহ করলেও খুব শিগগিরই রপ্তানিতে যাবে প্রতিষ্ঠানটি। ইতিমধ্যে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভুটান, মধ্যপ্রাচ্যে ও আফ্রিকার সাথে কথাবার্তা চলছে। এছাড়াও ভবিষ্যতে মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপও তৈরী করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০০২ সালে মাইওয়ান ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রিজের যাত্রা শুরু হয়।
তাদের গাজীপুরের কারখানায় টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এসি, ব্লেন্ডার ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স পন্য তৈরী করা হয়। তাছাড়া ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদি পণ্যও সংযোজন করা হয়।
সেখানেও প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখেরও বেশী রেফ্রিজারেটর বিক্রি করে কোম্পানিটি। ২০১৩ সালে বাজারে আসে মিনিস্টার ব্র্যান্ড। এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বেলুন ও কবুতর উড়িয়ে কারখানার উদ্বোধন করেন এবং কারখানা ঘুরে দেখেন।