আন্তর্জাতিক ডেস্ক,নরসিংদী প্রতিদিন,রবিবার,৭ অক্টোবর ২০১৮:
ধাঁধানো তাবরিজ মহাবাজার। ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহরে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে শোভা পাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাজারটি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাদে ঢাকা বাজার। পরস্পর সংলগ্ন সুদৃশ্য ছাদযুক্ত তাবরিজ বাজার মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বিস্ময়কর স্থাপত্য-শৈলী আর বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে বিশ্বে অনন্য এটি। সুবিশাল ছাদের নিচে গড়ে ওঠা তাবরিজ বাজারের যেন কোনো শেষ নেই। যার অসাধারণ রঙিন কারুকাজ আর জটিল কাঠামোতে গোলক ধাঁধায় পড়ে যাবে যে কেউ। ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক পণ্য সামগ্রী আর প্রাচ্য দেশীয় বাহারি মশলার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বাজার এটি।
ইরানের ঐতিহ্যবাহী বাজার সংস্কৃতি ও বাণিজ্য-ব্যবস্থাপনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই বাজার। তাবরিজ শহরের ঠিক কেন্দ্রে এই বাজারের অবস্থান। ১২ ও ১৮ শতকের মাঝামাঝি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল বাজার কমপ্লেক্সটি। এখন পর্যন্ত উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানের আর্থিক কেন্দ্রস্থল এটি।
ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন সময় মার্কো পোলো, ইয়াকুত আল-হামাউজি এবং জিন চার্দিন এর মতো অনেক অভিযাত্রী ও লেখক তাবরিজ বাজারের গরিমার প্রশংসা করেছেন। বাজারটিকে তারা তাদের অভিযানের একটি স্মরণীয় অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো তাবরিজ বাজারকে বিশ্বের ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। সিল্ক রোডের সাথে এটি গড়ে ওঠায় এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী তাবরিজ বাজার পাড়ি দেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান বাজারটিকে শতাব্দী কাল ধরে বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
তাবরিজ বাজার সবচেয়ে গৌরবময় দিন পার করেছে ১৬ শতকে। তখন তাবরিজ ছিল সাভাবিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী। কিন্তু পরের ১৭ শতাব্দীতে রাজধানীর মর্যাদা হারায় শহরটি। তবুও এখনও গৌরবান্বিত তাবরিজ বাজার।
১৯ শতকে ইরানের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের ২৫ শতাংশই হতো এই তাবরিজ বাজারে। এমনকি রাজধানী শহর তেহরানে যে পরিমাণ বাণিজ্য হয়েছে তার চেয়ে বেশি বাণিজ্য হওয়ার রেকর্ড রয়েছে বাজারটির।
ঐতিহ্যবাহী বাজার কমপ্লেক্সটি এক ধাপে নির্মাণ করা হয়নি। আর্কিটেক্টরা কয়েকটি ধাপে বিভিন্ন সময়ে বাজারটির সঙ্গে বিভিন্ন অংকে জুড়ে দিয়েছেন। বাজারের পশ্চিম পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক তাবরিজ জামে মসজিদ। পূর্বে প্রাদেশিক গভর্নরের প্রাসাদ। আর উত্তরে রয়েছে মেহরানেহ নদী।
প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েকবার এ বাণিজ্য কেন্দ্রটির সংস্কার করা হয়। সর্বশেষ সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় হিজরী দ্বাদশ শতকে। তাবরিজ বাজারের আয়তন এক বর্গ কিলোমিটার। এই বাজারে রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার দোকান যেখানে পাওয়া যায় ৪০ ধরনের পণ্য। বাজারটির সাথে রয়েছে আরও ৬০টি ছোট ছোট বাজার। রয়েছে প্লাস্টারের কারুকাজ করা দর্শনীয় কিছু গম্বুজ ও খিলান। নকশা ও ইটের কারুকাজও অপূর্ব সুন্দর। দোকান-ঘরগুলোর সংখ্যা ও সেগুলোর দরজার সাজ-সজ্জা বা কারুকাজও দর্শকদের অভিভূত করে।
বিভিন্ন আবাসস্থল, সরকারি ভবন, স্থাপনাও গড়ে উঠেছে এই বাজারের আশপাশেই। এই বাজারের পাশে গড়ে উঠেছে ৩০টি মসজিদ, ১২টি স্কুল, ৫টি গণ-গোসলখানা এবং ৫টি জাদুঘর। তাবরিজ শহরের প্রধান চারটি প্রবেশ-পথ রয়েছে তাবরিজ বাজারের সাথেই। সিল্ক-রোডের ব্যবসায়ীরাসহ অন্য যাত্রী ও জনতা এইসব প্রবেশপথ দিয়েই তাবরিজে প্রবেশ করত।
মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য অনেক বাজারের মতো তাবরিজ বাজারও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানকার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী আরমেনীয় ও জর্জিয়ান। তারা ইউরোপীয় ও মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ লেনদেন পরিচালনা করেন।
শক্তিশালী মাত্রার কয়েকটি ভূমিকম্পে এক সময় তাবরিজ মহাবাজার ধ্বংস হয়ে যায়। পরে বাজারটি পুনর্নিমাণ করা হয়। সর্বশেষ ১৭৮০ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর ধীরে ধীরে বাজারটি পুনর্নিমাণ করে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা হয়। ২০০০ সালে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থা দোকান মালিকদের সহায়তায় বাজারটির জন্য একটি উদ্ভাবনী প্রকল্প চালু করেন। স্থাপত্য-শৈলীর জন্য আগা খান অ্যাওয়ার্ড লাভ করে প্রকল্পটি।
বাজারের সুউচ্চ ভল্ট ও গম্বুজের নকশা করা হয়েছে অত্যন্ত সুনিপুনভাবে। ইট ও টাইলসের অসাধারণ কারুকাজে সুশোভিত এই গম্বুজ ও ভল্টগুলো অসামান্য শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। যা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকষর্ণের। কয়েকটি সাব-বাজার বা তিমচেহর সমন্বয়ে গড়ে ওঠেছে তাবরিজ বাজার। এই বাজারের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাশবহুল অংশ হচ্ছে আমির বাজার। যা তিমচেহ আমির নামেও পরিচিত। এখানকার দোকানগুলোতে স্বর্ণ ও জুয়েলারি পণ্য বিকিকিনি করা হয়। পুরো বাজারের মধ্যে এই সেকশনের গম্বুজটি সবচেয়ে বড়।
তাবরিজ বাজারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেকশন হচ্ছে মুজাফফরিয়ে বাজার। এটি তিমচেহ মুজাফফরিয়ে নামেও পরিচিত। এখানে পারসিয়ান গালিচা বিক্রি করা হয়। এই বাজারের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র বা কেনা-বেচার প্রাণকেন্দ্র এটি। বাজারের এই সেকশনের স্থাপত্য নকশা সর্বাপেক্ষা সুন্দর। এছাড়া সংলগ্ন অন্যান্য বাজারগুলোতে হস্তশিল্প, খাদ্যসামগ্রী ও গৃহস্থালীর বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করা হয়।