নিজস্ব প্রতিবেদক★
নরসিংদী প্রতিদিন,বুধবার,৩১ অক্টোবর ২০১৮।
আগামীকাল ১ নভেম্বর। নরসিংদীর পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ৭ বছর।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এরই মধ্যে দীর্ঘ ৭ বছর পলাতক থাকার পর গ্রেপ্তার হওয়া হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মোবারক হোসেন মোবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার শ্বশুর বাড়ি শহরের পশ্চিম ব্রাহ্মন্দী এলাকা থেকে সাত রাউন্ড গুলিসহ দুটি পিস্তল উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
এ ঘটনায় আজ বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাকে অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এদিকে মোবারক হোসেন গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিচারের দাবিতে উত্তাল লোকমান অনুসারী পৌরবাসী। তারা মোবারক হোসেনের ফাঁসি দাবি করে বুধবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও আদালত ঘেরাও করে। এর আগে গত বুধবার রাত ১১ টার দিকে রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসের একটি বাড়ি থেকে মোবারক হোসেন মোবাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ছাড়া লোকমান হোসেনের ৭তম মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জনবন্ধু শহীদ লোকমান পরিষদ। তারা প্রয়াত লোকমান হোসেনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পন, দোয়া মাহফিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, কাঙ্গালি ভোজ, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি মোবারক হোসেন ওরফে মোবা লোকমান হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ আগে থেকে মালয়েশিয়ায় পলাতক ছিলেন।
লোকমান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী ওই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মোবারক। গত ২৫ অক্টোবর মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে পলাতক অবস্থায় ছিল। নরসিংদীতে তার মালিকানাধীন একটি জমি বিক্রি করতেই দেশে এসে আত্মগোপনে ছিল মোবারক।
পুলিশ নজরদারী ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রুপন কুমার সরকার ও জাকারিয়া আলমের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে রাজধানীর ডিওএইচএসের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার সঙ্গে সাবেক ছাত্রলীগ রেহানুল ইসলাম ভূঁইয়া লেলিন নামের আরেকজনকে আটক করা হয়। লেনিনও বিভিন্ন মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি।
পুলিশ আরো জানায়, মোবারক হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্য মতে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে নরসিংদীতে তার নিজ বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যমতে শহরের পশ্চিম ব্রাহ্মন্দী মহল্লাস্থ তার শ্বশুরের বাসায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় ওই বাসা থেকে ৭ রাউন্ড গুলি ও ২টি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় আজ বুধবার বিকেলে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রুপন কুমার সরকার বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় বিকেল ৫ টায় তাকে আদালতে এনে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। পরে অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামীমা আক্তার ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে অস্ত্র আইনের মামলায় মোবারক হোসেনকে ২ দিনের রিমান্ড দেন আর লোকমান হোসেন হত্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন। রিমান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জাকারিয়া আলম।
এদিকে মোবারক হোসেনকে গ্রেপ্তারের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে নরসিংদী শহরের বিভিন্ন মহল্লায় বিক্ষোভ মিছিল করে লোকমান অনুসারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় মোবারকের ফাঁসির দাবি করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং আদালত ঘেরাও করে তারা।
আওয়ামী লীগ নেতাকমী ও লোকমানের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১ নভেম্বর পৌর মেয়র লোকমান হোসেনকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ হত্যার ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই বর্তমান মেয়র কামরুজ্জামান বাদী হয়ে তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে এক আসামি মোবারক হোসেন মোবা বিদেশে পলাতক ছিলেন। বাকি ১৩ জনের সবাই গ্রেপ্তার হলেও পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।
পুলিশ প্রায় দীর্ঘ ৮ মাস তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ২৪ জুন সালাউদ্দিনসহ এজাহারভুক্ত ১১ আসামিকে বাদ দিয়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। এতে মামলার এজহারভুক্ত তিন নম্বর আসামি শহর আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন, এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার, তার ছোট ভাই শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম সরকারসহ ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ২০১২ সালের ২৪ জুলাই নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে নারাজি দেন মামলার বাদী কামরুজ্জামান। আদালত ২৫ জুলাই নারাজি আবেদন খারিজ করে অভিযোগপত্র বহাল রাখেন। পরবর্তীতে ২৮ আগস্ট নারাজি আবেদন খারিজের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন বাদী। আদালত ২ সেপ্টেম্বর সেই আবেদন গ্রহণ করে ৪ নভেম্বর শুনানি শেষে ফের নারাজি আবেদন খারিজ করেন। এরপর উচ্চ আদালতে যান বাদী।
তিনি ওই অভিযোগপত্র বাতিল করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে নিম্ন আদালতে বিচারকার্য স্থগিত রাখতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। আদালত বাদীর আবেদনটি আমলে নিয়ে নিম্ন আদালতে বিচারকার্য স্থগিত করে দেন। এ ঘটনায় জামিনে বের হয়ে আসামিরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশনে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। এরই ধারাবিকতায় দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে মামলাটি।
মামলার বাদী নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, আমরা উচ্চ আদালতের কাছে সুষ্ঠু তদন্তের জন্যে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন করেছি। কিন্তু আসামিরা জামিনে বের হয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশনে রিট করে বিভিন্ন অজুহাতে শুধু শুনানীর দিন বিলম্বিত করে আসছে। এবার যেহেতু হত্যার মূল পরিকল্পনারকারী মোবারক হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছে। সেহেতু আমি মনে করি মামলার সঠিক তদন্তের দ্বার এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।
খবর: কালেরকণ্ঠ,নরসিংদী প্রতিনিধি।