ডেস্ক রিপোর্ট | নরসিংদী প্রতিদিন-
রবিবার, ৭১০ মার্চ ২০১৯:
সুজনের বয়স সাত বছর। এ বয়সেই বাংলামোটরের একটি মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপে কাজ নিয়েছে। কাজের প্রচণ্ড চাপ। ছোট্ট বাটিতে করে খাবার আনলেও তা খাওয়া হয়নি। ওস্তাদ একের পর এক কাজ ধরিয়ে দিচ্ছে আর বলছেন, ‘এটা করে খেয়ে নিবি’। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে। সুজনের মুখাবয়বজুড়ে প্রচণ্ড ক্ষুধার ছাপ। ওস্তাদের কথা না শুনলে কাজ শেখা যাবে না; রোজগারও করা যাবে না। তাই না খেয়েই মোটরসাইকেলের এটা-ওটা কাজ করে চলেছে শিশু সুজন। সারা দেশে এমন সুজনের সংখ্যা ১৭ লাখেরও বেশি। সবমিলে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ১৭ লাখ শিশু যারা পূর্ণকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে তাদের মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এ ছাড়া ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের মধ্যে যে শিশুরা সপ্তাহে এক ঘণ্টার বেশি কাজে নিয়োজিত থাকে, এ ধরনের শিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এসব শিশুর বড় অংশ ৩৮ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে। শিশুশ্রমিকের মধ্যে বড় একটি অংশ কাজ করে কৃষি খাতে।
শিশুশ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক কাজ করে রাজধানী ঢাকায়। পিতামাতা না থাকা এবং নদীভাঙনসহ নানা কারণে ছিন্নমূল হওয়া শিশু ও প্রান্তিক অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবিকার সন্ধানে ঢাকা এসে এসব শিশু স্কুলপাঠের বদলে জীবনের কঠিন পাঠ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। এদের কেউ নিজের জীবন বাঁচাতে, কেউ পঙ্গু বাবা-মাসহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে শ্রম বিক্রি করছে রাজধানীতে।
শিশু সন্তানের শ্রমের ওপর নির্ভর করে সংসার চলে এমন একটি পরিবারের অভিভাবক আছিয়া খাতুন। তিনি নিজে আরামবাগের মেসে কাজ করেন। ১০ বছরের ছেলে আসাদ কাজ করে প্রেসে। আছিয়া খোলা কাগজকে বলেন, ‘ছেলির দিয়া কাজ করাই কি আর সাধে! নিজের যা আয় হয় তা দিয়া সংসার চলে না। ছেলির কাজ করার ট্যাকা দিয়া কুনোমতে চলে। ছেলিডাক স্কুলে পাঠাতে পারলি তো ভালো হইতো। আমার সংসার চলবি কিসে?’
আছিয়ার মতে, ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে হলে লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি পরিবারের খরচ জোগানের জন্য কিছু টাকাও প্রয়োজন। তা নাহলে ঢাকাতেই থাকতে পারবেন না আছিয়া। ‘অনেকেই ছেলিক স্কুলে যাওয়ার লাইগা বুলে। মুখের কথায় হবিনি, আমার ছেলিক আমার চায়া কারো বেশি দরদ নাই’ বলেন আছিয়া।
দেশে বেশ কিছু এনজিও শিশুশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে ইসলামিক রিলিফ ওয়ার্ল্ডওয়াইড বাংলাদেশ অন্যতম। বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি ২৭৫টি পরিবারকে বেছে নিয়েছে। এসব পরিবারের প্রতি অভিবাবককে এককালে ব্যবসার জন্য ১৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। যা দিয়ে ওই অভিভাবকরা আয়বর্ধক কোনো কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি ওই পরিবারের শিশুদের মাসে ৫০০ টাকা করে এনজিও থেকে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ টাকা শিশুদের স্কুলের খরচ জোগান দিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স কো-অর্ডিনেটর সফিউল আযম বলেন, ‘আমরা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ঢাকার কেরানীগঞ্জে শিশুশ্রম দূরীকরণবিষয়ক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করি। তারই সফলতার ধারাবাহিকতায় কামরাঙ্গীরচরে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার মূল উদ্দেশ্য শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে এনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ এবং পরিবারকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা। প্রকল্পটি শতভাগ সফল এবং প্রকল্পভুক্ত ২৭৫টি পরিবারের প্রত্যেক শিশুই নিয়মিত পড়াশুনা করছে এবং পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’ তবে দেশের বিপুল সংখ্যক শিশুশ্রমিকের মধ্যে এ সংখ্যা সামান্যই।
সরকার দেশকে ২০২৫ সালের মধ্যে পুরোপুরি শিশুশ্রমমুক্ত করতে চায়। এর মধ্যে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমমুক্ত করতে চায়। এ জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিককে জনশক্তিতে রূপান্তর করা। সম্প্রতি ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি অ্যাডয়ার্ড বিগবেডার সাক্ষাৎ করতে এলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান জানান, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব প্রকার শিশুশ্রম নিরসনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে সরকার ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। এবং এ প্রকল্পের মাধ্যমে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহার করা হবে।’
তবে এ প্রকল্পের বাস্তবায়নের ধরন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় শিশুদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হবে। শিক্ষা শেষে এককালে কিছু টাকা দেওয়ার কথাও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের প্রশ্ন, যেসব শিশুকে কাজ থেকে মুক্ত করে ট্রেনিং দেওয়া হবে সেই সময়ে পরিবার এবং ওই শিশুর খাওয়া-পরার দায়িত্ব কে নেবে?
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএনএএফ) পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শুধু মুখে বলে শিশুশ্রম মুক্ত করা যাবে না। এ জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রয়োজন। শিশুকে কাজ থেকে সরিয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ওই শিশুর পরিবারের জন্য কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে এর অধীনেই এটা করা সম্ভব। পাশাপাশি শিশুটি কাজে নিয়োজিত হচ্ছে কি না, তার পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।’
খবর: জাফর আহমদ | দৈনিক খোলা কাগজ