ইসরাত জাহান। নরসিংদী প্রতিদিন-
শুক্রবার ১৩ এপ্রিল ২০১৯ :
কিছু ব্যাপারে একটু মুখ খুলবো আজ। ছবিতে যে বোরকা পরিহিত মেয়েটিকে দেখছেন সে আর কেউ নয়, আমি নিজেই। আজ থেকে ৬ বছর আগে, চোখেমুখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা এসেছিলাম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি জগন্নাথে চান্স পাওয়ার আগেও আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় চান্স পেয়েছিলাম। কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে মেয়েদের চলাফেরা পোশাক দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম (যদিও এখন এসব আমার কাছে কিছুইনা, প্রত্যেকেরই নিজস্ব পছন্দের পোশাক পরার অধিকার আছে)। কিন্তু তখন অনুভূতি ছিল এমন যে, আমি মফস্বলের বোরকা পরিহিত সাধারণ মেয়ে মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়টা আমার জন্য না।
এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যখন দেখি ক্লাসের ৮০% মেয়ে বোরকা পরে আসে তখন খুব ভালো লাগছিলো, কমফোর্ট ফিল হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমার জন্য জগন্নাথই উপযুক্ত। এখনও যখন এমন খবর শুনি যে জাহাঙ্গীরনগরে বোরকা পরার কারণে কিছু মেয়েরা টিচারদের কটূক্তি ও অপমানের শিকার হচ্ছে তখন খুব খারাপ লাগে। ধর্মীয় বিবেচনা বাদ দিলাম, সাধারণভাবে ভাবতে গেলেও যদি কোন মেয়ের জিন্স প্যান্ট শার্ট পরার স্বাধীনতা থাকে তবে বোরকা পরাও তার নিজস্ব ইচ্ছা স্বাধীনতার ব্যাপার। এক্ষেত্রে বাধা দেয়া টিচারগুলো নিঃসন্দেহে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি।
মুক্তমনা হতে হলে নিরপেক্ষতা, উদারতার গুণ আগে অর্জন করতে হয়। সব শ্রেণির, সব ধর্মের, সব পোশাকের মানুষকেই যদি তুমি শ্রদ্ধা না করতে পারো তবে তুমি কিসের মুক্তমনা? তুমি তো মূলত মুক্তমনার ছদ্মবেশে বদ্ধমনা। উদারতা ছাড়া উগ্র গন্ডিমার্কা মুক্তমনা আর ধর্ম নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা কুয়োর ব্যাঙ মার্কা ধার্মিক একই। এদের মধ্যে জাতগত পার্থক্য থাকলেও গুনগত কোন পার্থক্য নেই।
এবার গা ঘেষা প্রসঙ্গে আসি, জবিতে ভর্তি হওয়ার পর নতুন নতুন ঢাকায় এসেছি, রাস্তায় চলাচলে অনেক কিছুই ভয় ভয় লাগতো। রামপুরা বোনের বাসা ছিল। প্রথম ৩ মাস বোনের বাসা থেকেই ক্লাস করেছি, নিয়মিত। বাসে করেই ভার্সিটি আসতে হতো। এরপর যখন ভার্সিটির দিকে শিফট করলাম তখনও প্রতি সপ্তাহে বাসে করে বোনের বাসায় যেতাম। যথারীতি বোরকা পরেই বের হতাম। কোন কারণে বাসে কোন বিকৃতমনষ্ক পুরুষের সাথে বসতে হলে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। না পারতাম কিছু বলতে, না ছিলো প্রতিবাদ করার সাহস, লজ্জায় ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম।
>>> দেখা গেলো কোন এক বজ্জাতের সাথে বসতে হলো, যে কিনা নানা অযুহাতে নিজের হাত পা নাড়াচ্ছিলো, আমার গায়ে লাগানোর জন্য।
>>> মহিলা সিটে বসলাম, তার সামনেই ইঞ্জিনে বসা বিকৃতমনা লোকটা নিচে দিয়ে পা দিয়ে আমার পা ঘষছে।
>>> একদিন সাইডের সিটে বসেছিলাম, পাশেই দাড়ানো এক লোক তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে আমার বাহুতে ঘষছিল।
>>> ভিড়ের মধ্যে বাসে দাড়িয়ে ছিলাম একদিন, এক লোক পাছায় হাত ঘষছিল ইচ্ছে করে।
>>> বাসের হাতল ধরে দাড়িয়ে ছিলাম, এক ছেলে বারবার ইচ্ছা করে হাতের উপর হাত রাখছিল, অথচ হাত রাখার জায়গার অভাব তেমন ছিলনা বাসে।
>>> একদিন সিটে বসে লক্ষ্য করলাম পেছন থেকে কেউ সিটের ফাক দিয়ে পিঠে হাত দিচ্ছে।
>>> একদিন বাসে তাড়াহুড়ো করে উঠার সময় খেয়াল করলাম পেছন থেকে কেউ বাজেভাবে হাত দিচ্ছে বারবার, ফিরে তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম না কে করছে এটা কারন ভিড় ছিলো, আর বাসে না উঠেও উপায় ছিল না।
>>> আরেকদিন বাস থেকে নামার সময় খেয়াল করলাম, এক দাড়িসমেত এবং টুপি পরিহিত ভদ্রলোক বাসের সিঁড়িতে ইচ্ছাকরে আমার পেছনে তার হাঁটু দিয়ে অনেক জোড়ে গুতো দিয়েছিল। এতটাই জোরে যে বাস থেকে ছিটকে পরতে পরতে কোন রকমে সোজা হতে পারছিলাম।
>>> রাস্তা দিয়ে চলার সময় সেইম আরেক ভদ্রবেশি হুজুর কনুই দিয়ে আমার বক্ষে অনেক জোরে গুতো দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গিয়েছিল, আমি অনেক ব্যাথা পেয়েছিলাম সেদিন।
ভাইরে বিশ্বাস কর বা না কর তাতে কিছু যায় আসে না, এই ঘটনাগুলো আমার সাথেই ঘটছে, বোরকা পরিহিত অবস্থায়, তাও একবার না বহু বহুবার, যতবার বাইরে বের হয়েছি ততবারই কোন না কোন বিকৃতমনা তাদের বিকৃত স্পর্শে ক্ষতবিক্ষত করেছে আমার সরল মনটাকে। শুধু আমি মেয়ে বলে তা নয়, মায়ের মত বয়স্ক আন্টিদের সাথেও তারা সেইম কাজটাই করে কারণ মাংসপিন্ড তো, হিংস্র প্রাণীর কাছে সব মাংসই মজা, হোক তা কাচা বা পরিণত।
দুধের শিশু ছাড়া সবাই জানে এবং খুব ভালোভাবেই কল্পনাও করতে পারে যে, বোরকার নিচেই নারীর একটি আকর্ষনীয় দেহ আছে, একজোড়া বক্ষ আছে, একটা মাংসল কোমর আছে, নিতম্ব আছে। আর যারা ওই মাংসল দেহটার বিকৃত লালসায় পড়ে আছে, তাদের সামনে কোন পোশাকই বাধা না, সাতটি বোরকা পরে গেলেও তারা কল্পনায় নারীর উলঙ্গ রুপ দেখতে পায় এবং সুযোগ পেলেই স্পর্শ করে। বরং আজব মনে হলেও সত্য যে, বোরকাওয়ালীদের আরো বেশি স্পর্শ করে কারণ এই মেয়েরা স্বভাবতই একটু ভীতু, আর তাদের চক্ষুলজ্জাবোধটা অর্থাৎ প্রতিবাদ করলে লোকে কি বলবে এই বোধটা তাদের অনেক বেশি থাকে, তাই তারা কিছু না বলে চুপচাপ সহ্য করে যায়। বিকৃতমনষ্ক নুপুংশুকদের দ্বারা শিশুরা আজ এজন্যই বেশি ধর্ষিত হয় কারণ তারা দুর্বল, সরল, প্রতিবাদহীন, আর ওইসব বিকৃতরা এরকমই সুযোগ চায়। আমি দেখেছি, বিকৃতমনারা বরং জিন্সপড়া মেয়েদের ভয় পায় বেশি। কারণ, ওই মেয়েরা চক্ষুলজ্জার জাত মেরে দিয়ে বিকৃতমনাদের গেড়ে ফেলে দেয় জায়গাতেই।
আজ যে মেয়েগুলা “গা ঘেষবেন না” লিখে প্রতিবাদ করছে তাদের আমি ১০০% সাপোর্ট করি। সাপোর্ট করি এজন্যই যে তাদের চক্ষুলজ্জা বা লোকে কি বলবে এই টাইপের ভয় নেই বলেই এভাবে লিখে রাস্তায় প্রতিবাদে নামতে পারছে। আর এই মেয়েদের সাহসী প্রতিবাদের কারণে কেবল জিন্স পড়া মেয়েরাই নয়, বরং আপনার ঘরে থাকা বোরকা পরিহিত মা বোনরাও রাস্তায় সুরক্ষা পাবে। এরা হয়রানির শিকার হওয়া সব মেয়েদেরই নিরব কান্নার প্রতিচ্ছবি। উনাদেরকে পোশাক দিয়ে বিবেচনা না করে কি বুঝাতে চাইছে সেটা বুঝুন একবার। বিলিভ মি, বোরকা পরা মেয়েরা ভিড়ের মধ্যে আর বাসে আরো বেশি হয়রানিরর শিকার হয়। কোনদিন আপনার ভদ্র শালীন গা ঢেকে মাথা নিচু করে চলা বোনটাকে অভয় দিয়ে কাছে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করে দেখবেন একদিন, সে কতদিন এরকম হয়রানির শিকার হয়েছে! আপনি আজ শিক্ষিত ফেসবুক চালানেওয়ালা হয়েও এই মেয়েগুলার সমালোচনা করতে গিয়ে মনের অজান্তেই ওই বিকৃতমনাদের সাপোর্ট দিচ্ছেন। আপনি কোন মেয়ের গায়ে হাত দেননা বলে কেউ যে দেয়না, আপনি বোরকা পরা মেয়েদের সম্মান করেন বলে যে সবাই সম্মান করে, এই ধরনের একমুখী ভাবনা থেকে বের হয়ে আসুন। বিকৃতমনাদেরকে আপনার মা বোনদের গায়ে হাত দেবার সাহস আর যুগিয়েন না।
আমি নিজের ৬ বছরের বোরকা পরিহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলা বললাম। আমি গোটা ৩ বছর নিরব ছিলাম, ভয়ে লজ্জায় প্রতিবাদ করতে পারতাম না। এরপর নিজের আত্মসম্মানে যখন বারবার আঘাত পড়ছিলো তখনই নিজের অস্তিত্বের সম্মান রক্ষার তাগিদে প্রতিবাদগুলা ভেতর থেকে আপনাআপনিই প্রকাশিত হচ্ছিলো। প্রতিবাদ না করে আর কোন উপায় দেখছিলাম না। আর আজ যখন আমি ভিড়ের মধ্য দিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাই তখন দুই হাত কোমরের মধ্যে রেখে আশেপাশের বিকৃতগুলাকে কনুই দিয়ে গুতা দিতে দিতে হেঁটে যাই বিদ্রোহী, ভয়ংকর নারীর রুপ নিয়ে। আমি নিজের মধ্যেই অনুভব করি ‘অবলা’ কথাটির মধ্যেই একটি না বলা ‘বল’ কথাটি লুকিয়ে আছে। এ অবলার বক্ষের দুগ্ধ পান করেই একদা কোন ধর্ষক বল পেয়েছিল। এ অবলার বল প্রত্যেক নারীর মধ্যেই লুকানো আছে, কিন্তু ভয়, দ্বিধা, সংকোচ সে বলটিকে দমিয়ে রাখে।
আমি স্রষ্টার সৃষ্টি। আমি মানুষ। আমি পৃথিবীতে নারীরুপী মানুষ। আমার দুইখানা বক্ষ আছে, একটি যৌনাঙ্গ আছে, এটা তো সবাই জানে। আপনার মায়ের আছে, বোনের আছে, প্রেমিকার আছে, এটা কি আমাদের নারীদের দোষ? এটা কি লজ্জার? ঘৃনার? অসহাংত্বের প্রতীক?
বিধাতা আমাদের এ অঙ্গগুলো দিয়েছে পৃথিবীর প্রয়োজনে, আমরা বিধাতার কাছ থেকে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য অনুরোধ করে, ভিক্ষা করে এই অঙ্গগুলো আনিনি। আমরা বিধাতার পৃথিবী টিকিয়ে রাখতে এই মাতৃরুপে আবির্ভূত হয়েছি। মা হওয়ার জন্য অঙ্গগুলা নিয়ে জন্মেচ্ছি, আমাদের সন্তানদের পরম আদরে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা এই অঙ্গগুলোর অধিকারি হয়েছি এবং এ পৃথিবীর অস্তিত্বকে যত্নে টিকিয়ে রাখার জন্য জন্মেছি। কখনো কি কোন মেয়ের বক্ষ যুগলের দিকে তাকিয়ে একবার ভেবে দেখেছেন এরকম দুটি বক্ষই একসময় আপনার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল? আমরা তো মানুষ, আমাদের মা আছে, মায়ের ভালোবাসা আছে বলেই তো আমরা মানুষ। যেই মেয়েটিকে আজ মাগি বলে গালি দিচ্ছেন, সেই মেয়েটিই একদিন ‘গি’ ব্যাতিত ‘মা’ তে পরিণত হবে যার পায়ের নিচেই রচিত হবে সন্তানের বেহেশতখানা।
ইসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: (ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম)