নিউজ ডেস্ক | নরসিংদী প্রতিদিন-
বুধবার,০৩ জুলাই ২০১৯:
২০১৯-২০ অর্থ বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এক লাফে গ্যাসের দাম ৩২.৮ শতাংশ বাড়িয়ে এক চুলায় ৯২৫ টাকা ও দুই চুলায় ৯৭৫ টাকা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
কিন্তু উঠলো চিত্র আন্তর্জাতিক বাজারে, প্রতিবেশী দেশ ভারতও তাদের ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম কমিয়েছে। গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ কমে গেছে। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক তরল গ্যাস আমদানি শুরু করেছে। এই আমদানি করা গ্যাসের মূল্য বেশি এবং তার সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করার যুক্তি দেখিয়ে দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
বিশ্লেষকদের অভিযোগ, বিশ্ববাজারে যা দাম তার চেয়ে বেশি দামে বাংলাদেশ গ্যাস কিনছে। আর বিশ্ববাজারে দাম যখন কমে অর্ধেক হয়েছে, তখন ‘দাম বেশি’ যুক্তি দিয়ে দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। একটি যুক্তি দেয়ার চেষ্টা কেউ কেউ করছেন এভাবে যে, বাংলাদেশ যখন বিশ্ববাজার থেকে গ্যাস কিনেছে তখন দাম বেশি ছিলো। যুক্তি হিসেবে এটি যে খুব জোরালো নয় ভারতের দিকে তাকালে তার প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশ যখন ৮০০ টাকার গ্যাসের দাম ১৭৫ টাকা বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা করেছে, ভারত তখন ৭৬৩ রুপির গ্যাসের দাম ১০১ রুপি কমিয়ে ৬৬২ রুপি নির্ধারণ করেছে। ভারতও বিশ্ববাজার থেকেই গ্যাস কিনছে। পৃথিবীর সব দেশই দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির ভিত্তিতেই গ্যাস কেনে এবং বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে বাড়ে, কমলে দেশেও কমে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও দেশে দাম বাড়ে, কমলেও দাম বাড়ে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘একই দৃশ্য আমরা তেলের ক্ষেত্রেও পাই। বিশ্ববাজারে তেলের দাম গত কয়েক বছর ধরে কম থাকলেও বাংলাদেশে তা কমানো হয়নি। একইভাবে গ্যাসের দামও কমানো হয় না। সরকারের নীতি, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত ক্রমাগতভাবে কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ব্যবসার জন্যে নিশ্চিত করা হবে। তারা এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবসা নিশ্চিত করতে চায়। বাংলাদেশে যদি গ্যাসের সঙ্কট না থাকে তাহলে তো এলএনজি ব্যবসা নিশ্চিত করা যাবে না।’
জ্বালানিখাতের অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি-অযৌক্তিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা এই অর্থনীতিবিদের দাবি, ‘গত ১০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখেছি যে সরকার জাতীয় সংস্থা বাপেক্সকে গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ দিচ্ছে না। এবং সংস্থাটির যতোটুকু সক্ষমতা রয়েছে সেটির ব্যবহারের পথে নানান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর যে সুযোগ-সম্ভাবনা ছিলো তা কাজে লাগানো হয়নি। এগুলোর জন্যে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি পরিমাণের টাকা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে পড়ে রয়েছে। এসব কারণে গ্যাসের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে অনেক বেশি দামে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এই গ্যাস সঙ্কটের কথা বলে এলএনজি আমদানির যৌক্তিকতা দেওয়া হয়েছে। ঘটনাক্রম প্রমাণ করে, পুরো বিষয়টি পরিকল্পিত ছিলো।’
‘সরকারের মূল এজেন্ডা হচ্ছে যে গ্যাস সঙ্কটকে একটি অজুহাত হিসেবে তৈরি করে একদিকে এলএনজি বা এলপি গ্যাসের ব্যবসা অন্যদিকে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যৌক্তিকতা তৈরি করা।’
তার অভিযোগ, ‘দেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক স্বার্থান্বেষীদের আস্তানা। তারাই প্রকল্প ঠিক করে দিচ্ছে, নির্দেশনা দিচ্ছে আর মন্ত্রণালয় বা অন্যান্যরা হয় কমিশনের কারণে কিংবা ঘুষ বা অন্যান্য দুর্নীতির কারণে সেসব পথে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘কোনো দ্রব্যের উৎপাদন খরচ কিংবা বিতরণ খরচের ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত কোনো প্রয়োজন হলে দ্রব্যের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদনকারী এবং বিতরণকারী সংস্থাগুলো দুর্নীতিমুক্তভাবে স্বচ্ছতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলে দেশে গ্যাস আমদানির চাহিদা অনেক কমে যেত।
নাজনীন আহমেদ বলেন, গ্যাস উৎপাদনকারী এবং বিশেষ করে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিমুক্ত হলে, নিজেদের সিস্টেম লস কমালে এবং কার্যকরভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলে বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা প্রয়োজন হয় না। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ এতটা অসন্তুষ্ট হতো না যদি উৎপাদন ও বিতরণে সিস্টেম লস বা দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা জবাবদিহিতার প্রয়াস থাকতো কর্তৃপক্ষের।’