লক্ষন বর্মন। নরসিংদী প্রতিদিন-
শুক্রবার ০২ আগস্ট ২০১৯:
আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারো নরসিংদীর খামারীরা সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে গরুর, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া মোটাতাজা করছেন। শেষ মুহুর্তের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার খামারীরা। কোন ধরণের রাসায়নিক ও মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগ ছাড়াই সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে দেশীয় খাবার খাইয়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। তাই এবার কোরবানীর হাটকে ঘিরে বেশ আশাবাদি হয়ে উঠেছেন। খামারগুলোতে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ১ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে ৫ লক্ষ টাকা মূল্যের গরু প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে বিদেশী গরু আমদানি না হলে এবছর পশু বিক্রি করে লাভবান হওয়ার আশা করছেন খামার মালিকরা।
জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ঈদকে সামনে রেখে জেলার ছয়টি উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার খামারী দেশীয় পদ্ধতিতে ২৫ হাজারের বেশি পশু মোটাতাজা করছেন। দেশের বিভিন্ন হাট থেকে গরু কিনে ৬ মাস ও ১ বছর আগে থেকে গবাদি পশু লালন পালন শুরু করেন নরসিংদীর খামারীরা। কোরবানির ঈদকে ঘিরে অসাধু গরু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ করলেও এখানকার খামার গুলোতে দেশীয় খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়েছে এসব গরু ও মহিষ গুলোকে। দেশীয় পদ্ধতিতে মোটাতাজাকরণ করায় এই অঞ্চলের গরু ও মহিষের চাহিদাও অনেক বেশি। এসব ফ্রামের গরু ও মহিষ আশপাশের জেলা সহ বিভিন্ন হাটগুলোতে সরবরাহ করবেন বলে জানিয়েছেন খামারীরা।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, অসাধু গরু ব্যবসায়িরা কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ করলেও দেশিয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ করছেন নরসিংদী জেলার খামারিরা। প্রতি বছরই ঈদ এলে গরু বিক্রি করে বাড়তি আয় করেন এই জেলার খামারিরা। ছোট বড় খামারের পাশাপাশি প্রতিটি খামারি ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজা করে থাকেন। নিষিদ্ধ ঘোষিত ক্ষতিকর ইনজেকশন ও ট্যাবলেট পরিহার করে ঘাস খড়ের পাশাপাশি খৈল, গুড়া, ভূষি খাদ্য হিসেবে খাওয়ানোর মাধ্যমে মোটাতাজা করা হয়েছে এসব গরু। বাজারে দেশিয় গরুর ব্যাপক চাহিদা থাকায় এই ঈদে লাভজনক হবেন বলে আশাবাদী তারা।
রায়পুরার চরাঞ্চলের চরমধুয়া গ্রামের গ্রীণ এগ্রো ফার্মস এর মালিক মুজিবর শিকদার বলেন, আমার খামারে ৫০টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি গরু সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে দেশীয় খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি গরুকে কাঁচা ঘাস, খড়, তিলের খৈল, ছোলার খৈল, মসুুরী ডালের খৈল, মটরসহ বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ানো হয়েছে।
সম্পূর্ণ প্রাাকৃতিকভাবে এসব গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। দেশিয় গরুর চাহিদা থাকায় এরমধ্যে খামার পরিদর্শনে আসছেন ক্রেতারা। অনেকে খামার থেকেই গরু কিনে নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। নিজের কোরবানির গরু সংগ্রহ ও মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত গরু প্রদানের জন্যই আমার এ উদ্যোগ। দেশিয় পদ্ধতিতে মোটাতাজকরণ করা গরুগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেক খামারেই বিক্রি হয়ে গেছে। বাজারেও চাহিদা হয়েছে দেশিয় জাতের এসব গরুর।
তবে এবার ঈদে বিদেশী গরু সর্ম্পূণরূপে আমদানী বন্ধ করা গেলে এবার ঈদে লাভবান হব আমরা। এছাড়া এবছর ভাল বিক্রি হলে আগামীতে গরু খামারের মাঝারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা আরো খামার তৈরীতে আগ্রহী হবে।
শিবপুর উপজেলার মুন্সেফেরচরের গরু খামারি কিবরিয়া গাজী বলেন, দেশীয় পদ্ধতিতে মোটাতাজাকরণ করায় এই অঞ্চলের গরুর চাহিদা অনেক বেশি। আর তাই ঈদের বেশি দিন সময় না থাকায় গরুর যতেœ এখন ব্যাস্ত সময় পার করছি আমরা। আমার খামারে প্রায় একশত গরু কোরবানীর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মানব দেহের ক্ষতি হবে এমন কোন ঔষধ ছাড়াই সম্পূর্ণ দেশীয় খাবার খাইয়ে গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। গরু কিনে মোটাতাজা করা পর্যন্ত প্রতিটি গরুতে ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ১ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে ৫ লক্ষ টাকা মূল্যের গরু প্রস্তুত করা হয়েছে।
আলীজান জুট মিলস্ এর গোশালার তত্বাবধায়ক মোশারফ হোসেন বলেন, আমার এখানে একশ মহিষ ও ৪০টি গরু দেশিয় পদ্ধতিতে মোটাতাজাকরণ করেছি। মোরা, নীলীরাবী, এলবীনো ও এলবীনো মোরা চার জাতের মহিষ আছে। নিরাপদ মাংসের জন্য এবার আমরা গরুর পাশাপাশি মহিষ মোটাতাজাকরণ করছি। আমরা মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের জন্য গরু থেকে মহিষের মাংস নিরাপদ মনে করছি বলে গরু থেকে মহিষের দিকে নজর দিচ্ছি। গরু লালন পালন করতে যে জনবল প্রয়োজন তার অর্ধেক জনবল দিয়ে মহিষ লালন পালন করা যায়। দেশিয় পদ্ধতিতে মোটাতাজাকরণ করা গরু চেয়ে মহিষের লাভ বেশি হয়। আমাদের নিজস্ব খামারের ঘাস, খড়ের পাশাপাশি খৈল, গুড়া, ভুষি খাদ্য হিসেবে খাওয়ানোর মাধ্যমে মোটাতাজা করা হয়েছে এসব মহিষকে। এখানকার গরু ও মহিষ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে এ বছর কোরবানি ঈদে ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ থাকলে দেশীয় গরু ব্যবসায়ীরা লাভবান হব বলে আশা করছি।
জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা, ডা. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ঈদকে সামনে রেখে জেলার ছয়টি উপজেলায় ছোট-বড় ৫ হাজার ২শত ৭১ জন খামারী দেশীয় পদ্ধতিতে ২৪ হাজার ৩শত ২৬টি পশু মোটাতাজা করছেন। মোটাতাজা করণ পশুর মধ্যে রয়েছে ষাড়, বলদ, গাভী, ছাগল ও ভেড়া। এরমধ্যে নরসিংদী সদরে সর্বমোট ৩,৬০৭টি, রায়পুরায় ২,৬৩৮টি, বেলাব ৫,১৬০টি, পলাশ ৪,৩৮২টি, শিবপুর ৩,১৬৮টি ও মনোহরদী ৫,৩৭১টি সম্ভাব্য পশু রয়েছে। এছাড়াও পশু মোটাতাজাকরণে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ঔষধ ব্যবহার বন্ধে মাঠ পর্যায়ে তদারকির কথা জানালেন জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগ। জেলায় উৎপাদিত পশু নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্যজেলায় রপ্তানী সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। মেডিসিন ব্যবহার না করে দেশীয় প্রযুক্তিতে প্রাকৃতি ঘাস, খড় ভূসি ও দানাদার খাবার খাওয়ায়ে গরু মোটা তাজা করণে খামারীদের উৎসাহিত করা হয়েছে। এছাড়া গরু মোটা তাজা করনে কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার রোধে সার্বক্ষনিক মনিটিরিং করছে আমাদের লোকজন। প্রতিটি হাটে গরু গুলি পরীক্ষা করার জন্য মনিটরিং সেল বসানো হবে। দেশীয় পদ্ধতিতে মোটাতাজাকরণ করায় এই অঞ্চলের গরুর চাহিদাও অনেক বেশি।