ডেস্ক রিপোর্ট | নরসিংদী প্রতিদিন- সোমবার , ২৬ আগস্ট ২০১৯:২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। ওই দিনটিতে দলে দলে কাতারে কাতারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারে। মিয়ানমারে সেনা নিগ্রহ, বাড়িঘরে জ্বালাও-পোড়াও, গণধর্ষণ ও গণহত্যার মুখে শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচার তাগিদে ওই দিন থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত ও সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করে। এর পরবর্তী টানা কয়েক মাস জন্মভিটার মায়া ভুলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ সরকারও পরিস্থিতি সামলে নিতে মানবিক অবস্থান থেকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান থেকে শুরু করে গত দুই বছর রোহিঙ্গাদের যথাসাধ্য সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও উদ্বাস্তু এইসব মানুষদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে।
গতকাল রবিবার ছিল ২৫ আগস্ট। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার দুই বছর পূর্তি। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে গত দুটি বছর রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে কীভাবে তাদের জীবন কাটিয়েছে, তাদের দিনগুলো কেমন ছিল, কতটা সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছে বিগত সময়গুলোতে- এ নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
এরকম কিছু প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা ক্রমশ বাংলাদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে কক্সবাজারের উপকূলীয় শরণার্থী শিবিরগুলোতে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ভিটেমাটি হারা এইসব রোহিঙ্গারা অনেকক্ষেত্রে জীবন ধারণের প্রয়োজনে কিছু টাকার প্রলোভনে ইয়াবা, মানব পাচারের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এভাবেই দিন দিন বিভিন্ন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। চলছে অস্ত্রের মহড়াও। বাড়ছে খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধ।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে দিন দিন। মানবিক দিক বিবেচনায় যে রোহিঙ্গাদের দুই বছর আগে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল তারাই এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। ইয়াবা পাচার, চুরি-ডাকাতি ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে গত দুই বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৪ শতাধিকেরও বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামি হাজারও রোহিঙ্গা।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গেল ২ বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ৪৪ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ৩২ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের প্রবেশের পর ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। যার মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১ টি। এসব মামলায় আসামি ১০৮৮ রোহিঙ্গা।
অবিলম্বে এইসব রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলেই বিশ্লেষকদেরও ধারণা। কারণ রোহিঙ্গারা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে করে একটা সময় তারা নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন চাইলেও পরিস্থিতি মোকাবিলা হয়তো সম্ভব হবে না।
এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কারসাজিতে পরপর দু’বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পড়েছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গাদের চরমপন্থা, অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সহিংস আচরণে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও ভাবনায় পড়েছে।’
তবে রোহিঙ্গাদের যেকোনও ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পগুলোতে অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ।
যদিও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা বেশিরভাগ সময়ই অলসতায় কাটায়। তাদের হাতে কোনও কাজ নেই। সে কারণে তাদের মাথায় অনেক সময় দুষ্টবুদ্ধি কাজ করে। আগে তাদের খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসার চিন্তা ছিল। এখন সেই চিন্তাও নেই। আর ক্যাম্পগুলোতে প্রচুর যুবক বয়সী আচে, যারা এই অলস সময়টাকে ছুড়ে দিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। স্থানীয়রা এখন এদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আমরা নিয়মিত টহল জোরদার রেখেছি।’
তবে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে সংখ্যাগত দিক দিয়ে একটু খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এমনকি এ ব্যাপারে বারবার আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা মিয়ানমার কথা দিয়েও তা ভঙ্গ করছে। তারা তাদের লোকদের ফিরিয়ে নিতে কোনোই উদ্যোগ নিচ্ছে না।
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একটি চুক্তি সই করে। পরে দু’দেশ ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামে চুক্তি করে। ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ অনুযায়ী, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার দুই বছরের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল।
গেল বছরের ১৫ নভেম্বর প্রথম দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। কিন্তু রাখাইন পরিস্থিতি অনুকূল না থাকার অজুহাতে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরে যেতে রাজি হয়নি। বন্ধ হয়ে যায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এর প্রায় ৯ মাস পর গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের দিন ঠিক করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয় ব্যাপক প্রস্তুতিও। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহ-অনিচ্ছার কারণে এবারও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। উল্টো ওই দিনই রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে রাখাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নাগরিকত্বসহ ৪টি শর্ত জুড়ে দেয়। আর এই শর্তগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা একজনও মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নন বলে জানান।