নিউজ ডেস্ক | নরসিংদী প্রতিদিন –
সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০১৯ : বিভিন্ন দেশ মাত্র ৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা কেজিতে। আর এতে দেশে পেঁয়াজের বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। খোদ আমদানিকারকরাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে এই দরের ঘোষণা দিয়েছেন। এ অবস্থায় বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ তাই এখন আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতাদের দিকে।
সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে এই নৈরাজ্য সৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে সিন্ডিকেট জড়িত। অতি মুনাফার লোভে তারা পেঁয়াজ মজুদ করে দাম বাড়িয়ে চলেছে। আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতারা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করছেন। বলা হচ্ছে, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ। অন্যান্য দেশ থেকেও আমদানি হচ্ছে চাহিদার অনেক কম। সরবরাহ কম থাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাজারে। অথচ বাজারে পেঁয়াজের বিপুল সরবরাহ রয়েছে।
এনবিআরের শুল্ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুলাই থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোট পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৫১ হাজার ৮২৬ টন। মোট ৭৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে আনা এসব পেঁয়াজের মধ্যে ভারত থেকেই আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৩২ হাজার টন। এর পুরোটাই এসেছে ভারতের রপ্তানি বন্ধের আগে এবং ওই সময় পর্যন্ত খোলা এলসির বিপরীতে। এসব পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৩০ টাকা কেজি দরে। শুল্ক বিভাগের কাছে আমদানিকারকরা এই দামই ঘোষণা করেছেন।
এর বাইরে আমদানি হওয়া ২০ হাজার টন পেঁয়াজের বড় অংশ এসেছে মিয়ানমার থেকে, ১৭ হাজার ৩৪৫ টন। এসব পেঁয়াজের দাম ঘোষণা হয়েছে ৪৩ টাকা কেজি। মাত্র ২৩ টন পেঁয়াজ এসেছে থাইল্যান্ড থেকে। উড়োজাহাজে আনা এসব পেঁয়াজের দাম পড়েছে ১৩৩ টাকা কেজি।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এ ব্যাপারে বলেন, ‘আসলে কারা কত টাকা দরে পেঁয়াজ এনেছে বা এ জন্য এনবিআরের দিক থেকে করণীয় নির্ধারণে কর্মকর্তাদের নিয়ে আগামীকাল (আজ সোমবার) বসব। আলোচনা করেই করণীয় ঠিক করা হবে।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার এম ফখরুল আলম বলেন, ‘আমাদের কাছে এখন সবচেয়ে অগ্রাধিকার পণ্য হলো পেঁয়াজ। এর চালান আসামাত্র দ্রুততার সঙ্গে খালাস করা হচ্ছে। তবে খালাসের পর কারা মজুদ করছে বা বেশি দামে বিক্রি করছে তা দেখবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা। পেঁয়াজ নিয়ে কোনো কারসাজি বা অন্য কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে অবশ্যই তারা তা দেখবে।’
এনবিআরের শুল্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিমূল্য ঘোষণা করা হয়েছে ৩০ টাকা কেজি, মিয়ানমার থেকে ৪৩ টাকা আর থাইল্যান্ড থেকে ১৩৩ টাকা। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি আপাতত বন্ধ থাকলেও সংশ্লিষ্টরা যে আগে আমদানি করে মুজদ করেনি তার গ্যারান্টি নেই। এখন তো দেখছি মজুদ করা পেঁয়াজ পচে যাওয়ায় নদীতে ফেলা হচ্ছে। কিছু অসাধু পাইকারি বিক্রেতা ও আমদানিকারক কম দামে আনা পেঁয়াজ বেশি দামে বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা লোটার আশঙ্কা রয়েছে।’
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আজিজুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এর পেছনে একটি চক্র সক্রিয়। এরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের বাড়তি মুনাফা নিচ্ছে। আমি মনে করি, এখন এদের ধরা উচিত। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা কে কত দামে আমদানি করেছে, কে কোথায় কত দামে বিক্রি করেছে—এ তথ্য কাস্টমসের কাছেও আছে। এটা মেলালেই তো সব কিছু বেরিয়ে আসবে।’
ড. আজিজুর রহমান আরো বলেন, ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা একেক সময়ে এ রকম অঘটন ঘটায়। এরা আমদানি করে। তারপর ১৫ দিন ধরে রাখলেই তো বাজারে সংকট তৈরি হয়ে গেল। এরপর তা বাজারে ছাড়ে, বাড়তি মুনাফা পকেটে ভরে। আর সাধারণত পাইকারি বিক্রেতারাই কারসাজিটা করে। আর রাজনৈতিক কানেকশন ছাড়া এমন কারসাজি সম্ভব নয়। কারো না কারো ছত্রচ্ছায়ায় এ ঘটনা ঘটছে। আমি মনে করি, এই বাজার কারসাজিতে জড়িতদের ফায়ারিং স্কোয়াডে দেওয়া দরকার। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করছে মানুষ। এটা করলেও বাহবা দেবে।’
আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাজেদ বলেন, ‘আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। আমরা কোনো সিন্ডিকেট বা চক্রের সঙ্গে নেই। যারা বাড়ায় তাদের ধরা হোক। আমার কাছে কিছু পেঁয়াজ আছে। তাই মিসর বা অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানির জন্য এলসি খুলিনি। অনেকে এখন পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা বলছে। ক্রসফায়ার দিক, আমরা কী করব?’ আবদুল মাজেদ স্বীকার করেন যে কোরবানির ঈদের সময় তিনি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। তবে তা ৩০ টাকা কেজি দরে কেনা কি না এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি জানান, দেশে প্রতিদিন ছয় হাজার টন পেঁয়াজের সরবরাহ দরকার। এর মধ্যে পাঁচ হাজার টন সরবরাহ থাকলেও দামে প্রভাব পড়বে না।
আরেক আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেনও প্রায় একই সুরে কথা বলেন। জানান, তিনি চীন থেকে ৩০০ টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খুলেছেন। দাম পড়েছে ৭০ টাকা কেজি। ভারত থেকে তিনি পেঁয়াজ আমদানি করেননি। ৩০ টাকায় ভারত থেকে পেঁয়াজ এনে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেটের কথা বলে সবাই। আমরা শুনি আর হাসি। দাম যখন কম ছিল আমরাও কমে বিক্রি করেছি। আর সরবরাহ কমলে ব্যবসায়ীরাই বাজারে দাম ঠিক করে। সরবরাহ বেশি থাকলে ক্রেতারা ঠিক করে। এটাই স্বাভাবিক।’ তিনি জানান, কয়েকজন আমদানিকারক মিসর, চীন ও পাকিস্তান থেকে প্রায় পাঁচ শ কনটেইনার পেঁয়াজের এলসি খুলেছেন। আট থেকে ১০ দিনের মধ্যে এসব পেঁয়াজ বাজারে আসবে।
এদিকে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতার ইস্যু নিয়ে গতকাল বিকেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন বাণিজ্যসচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন। বৈঠকে উড়োজাহাজে আনা পেঁয়াজ বিমানবন্দরে পৌঁছামাত্রই বাজারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। বাণিজ্যসচিব অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেঁয়াজ খালাসের নির্দেশনা দেন। বিমানবন্দরে পেঁয়াজ খালাসে যাতে সময়ক্ষেপণ না হয় এ বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়। বৈঠকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র : কালের কন্ঠ