ডেস্ক রিপোর্ট | নরসিংদী প্রতিদিন-
শনিবার-১৮ জুলাই ২০২০:
নরসিংদীতে উচ্চশিক্ষিত হয়েও কঠিন জীবনসংগ্রামের মুখোমুখী রফিকুল ইসলাম ও মীম নামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এক দম্পতি। ভালোসেবে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ এই দম্পতির একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পন্ন করেছেন অনার্স-মাস্টার্স। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে এখন ছোট সংসার তাদের। তবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় চালিয়ে যেতে হচ্ছে কঠিন জীবনসংগ্রাম।
সংসার জীবনে পা দেয়ার শুরু থেকে এতদিন আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায় কোনমতে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকলেও মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের পর দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এই দম্পতির জীবন সংসার। কারণ স্বজনরাই এখন চলতে হিমশিম খাচ্ছেন। বর্তমানে অন্যের মুখাপেক্ষি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এ দম্পতির দিন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, নরসিংদী সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের দাসপাড়ার একটি বাসায় ভাড়ায় বসবাসকারী এই দম্পতির জীবন সংগ্রামের কথা। এ দম্পতি জানান, বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরির জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিয়েছেন তারা। অনেক ব্যাংকেও আবেদন করেছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাদের ভাগ্যে চাকরি জুটেনি কোন দপ্তরেই। আলোহীন চোখ নিয়ে দুজনেই দেশের খ্যাতনামা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হলেও চাকরি না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফায় অন্ধকার নেমে এসেছে তাদের সংসার জীবনে। চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা দুজনেই এখন ক্লান্ত। এ দম্পতির আবেদন শুধুমাত্র একটি চাকরির। যার সুবাদে যেন পান তিনবেলা খেয়েপড়ে বেঁচে থাকা ও তাদের ছেলে-মেয়েকে মানুষ করার সুযোগ।
নরসিংদী রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের ফুলদী গ্রামের রফিকুল ইসলাম তিন বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টি হারান। নোয়াব আলী মোল্লার পাঁচ সন্তানের মধ্যে রফিকুল তৃতীয়। গাজীপুরের নীলের পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি, ২০০৭ সালে শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করেন।
শাহিদা আফরোজ মীম এর জন্ম চাঁদপুরের হাইমচরে। তাদের পাঁচ বোন ও এক ভাই। নদী ভাঙ্গনে তাদের সব কিছু বিলীন হয়ে গেলে তার পিতা আব্দুল আজিজ সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। এ সুবাদে ঢাকার মিরপুরে শৈশব কাটে তার। মীমও বয়স যখন তিন বছর তখন হামের কারণে দৃষ্টি হারান। বয়স যখন ১১ বছর তখন পিতাকেও হারান। তারপরও থেমে থাকেননি তিনি।
মীম মিরপুরের আইডিয়াল স্কুল এন্ড গার্লস কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এসএসসি, ২০০৫ সালে বেগম বদরুন্নেসা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ থেকে অনার্স ও ২০১১ মাস্টার্স করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে এক সিনিয়র শিক্ষার্থীর স্ত্রীর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মীমের সাথে যোগাযোগ হয় রফিকুলের। এরপর দুজনের পরিচয়। এ পরিচয় থেকে প্রেম-ভালোবাসা। দৃষ্টিশক্তি না থাকায় একে অপর কে না দেখলেও ভালোবাসার টানে ২০১১ সালে বিয়ে হয় মীম-রফিকুলের।
২০১৪ সালে তাদের ঘর আলো করে জন্ম হয় ছেলে শামিউল ইসলাম সিয়ামের। তার বয়স এখন ৬ বছর। পড়ছে সানবীম নামে একটি স্কুলের প্লে- গ্রুপে। ২০১৯ সালে জন্ম নেয় মেয়ে জান্নাতুল ফাতেমা।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় বাবার সহযোগিতায় জীবন চলতো। ২০১৫ সালে বাবা মারা যান। এরপর থেকে আমার অন্ধকার জীবনে অন্ধকার আরও প্রকট হয়ে উঠে। ভাবতে হচ্ছে দু’মুঠো আহারের কথা, দুই সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা। যদি একটি চাকরির ব্যবস্থা হয় তাহলে দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে হয়তো সন্তান দু’টিকে মানুষ করতে পারতাম। তা না হয়তো অন্ধকার ভুবনে অন্ধকারই থেকে যাবে। ‘
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রফিকুল বলেন, ‘এখন পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে, আর পারছি না। যদি কোন হৃদয়বান ব্যক্তি আমাদের সহযোগিতা করেন বা একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতেন, যা দিয়ে জীবন চলার পথ হবে আমাদের। ‘
মীম বললেন, ‘জীবনে কখনো ভাবিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেও চাকরি পাব না। ২০১১ সাল থেকে আমরা দুজন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চেষ্টা করেই যাচ্ছি। এখন আমাদের জীবনটা খুব কষ্টে কাটছে। মাসে সংসার চালাতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু আমাদের কোনো আয় নেই। ‘
মীম বলেন, ‘এমন যদি কেউ থাকতো আমাদের একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে সাহায্য করতেন। আর তা না হলে দুই সন্তান নিয়ে মরতে হবে। এছাড়া কী আর করার আছে আমাদের? খাবার না পেলে মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে?’
রফিকুল ইসলামের মা বৃদ্ধা জোবেদা খাতুন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ছোট থেকে টাইফয়েড জ্বরে চোখের দৃষ্টি হারা ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বড় করিয়েছি। পড়াশুনা করিয়েছি দেশের সুনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশা ছিল একটি চাকরি পেলে নিজে চলতে পারবে। স্বামীহারা আমি এখন আমি নি:স্ব। যে বয়সে মানুষ পরকালের চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর আমি এ বয়সেও দৃষ্টিহারা সন্তান ও তার দৃষ্টি হারা স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে আছি। এটাই কি আল্লাহ আমার ভাগ্যে লিখেছিল। তাদের কি কোন একটা চাকরির ব্যবস্থা হবে না।
নরসিংদী সুইড বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, আমার দেখা এই উচ্চশিক্ষিত দম্পতিটি তাদের দুটি সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তাই অসহায় এ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পরিবারটিকে বাঁচাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলসহ সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাই।
এই দম্পতিকে যদি কোন সুহৃদয়বান ব্যক্তি সহযোগিতা করতে চান তাহলে ০১৯১১-৪৭৭০০৭, ০১৯৩৮-১৯৮০৭০ নাম্বারে তাদের সাথে যোগায়োগ করতে পারেন।
খবর: নরসিংদী টাইমস