নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানির ভিডিও ধারণ এবং এক মাস পর সেই ভিডিও প্রকাশ করার ঘটনায় এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই তা দেখে নির্যাতনকারীদের মুখে থু থু ছিটাচ্ছেন। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ছাত্র-জনতা অবরোধে অচল হচ্ছে শাহবাগ। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই সেই ভিডিও অপসারণে বিআরটিসিকে নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একমাস আগে এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটলেও সেটি প্রকাশ্যে আসে ভিডিও প্রকাশের পর। গতকাল র্যাব-১১ জানিয়েছে, ধারণকৃত ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে গত একমাস ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়া ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায় চালিয়েও ব্যর্থ হয় অভিযুক্তরা। এরই একপর্যায়ে তারা ভিডিওটি প্রকাশ করে।
ইতোমধ্যে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারী এ ঘটনা নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলমগীর হোসেন একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ভুক্তভোগী ওই নারী পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন- অকথ্য নির্যাতনের মুখেও সম্ভ্রমটুকু রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি।
এসপি বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে আমরা একাধিকবার প্রশ্ন করেছিলাম, উনি বলেছেন- ‘ওরা অনেক চেষ্টা করেছে; কিন্তু আমি আমার সম্ভ্রমটুকু রক্ষা করতে পেরেছি। এই সুযোগেই ওরা ভিডিওটা ধারণ করে। ভিডিও ধারণের পর তারা আমাকে একাধিকবার কুপ্রস্তাব দিয়েছে ভিডিও ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে। তারপরও আমি তাদের ওই কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা ভিডিওটি প্রকাশ করে দিয়েছে’।’
মূলত ঘটনাটি একমাস আগের হলেও ভিডিও প্রকাশের পরই তা পুলিশের নজরে আসে। গেল রবিবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর সেই ভিডিওকে ভিত্তি করে প্রথমে ঘটনাস্থলে এবং পরে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় বলেও জানান এসপি আলমগীর।
তিনি জানান, শুরুতে ঘটনাস্থল ও এলাকার সম্ভাব্য সব জায়গাতে খোঁজা হয়। ২-৩ ঘণ্টা খুঁজেও কোথাও ওই নারীকে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত নোয়াখালী সদরের একটি হাউজিং এলাকা থেকে ভুক্তভোগী নারীকে উদ্ধার করা হয়। তিনি মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছিলেন। তার মানসিক চাপ কমাতে শুরুতে কাউন্সেলিং করা হয়, তারপর তার মানসিক স্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ধীরে ধীরে কার কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়।
ওই নারীর ভাষ্য- ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর এশার নামাজের আগমুহূর্তে ঘটনাটি ঘটে। প্রথমে তাকে প্রলোভন দেখানো হয়, পরে কুপ্রস্তাব দেয়া হয়, তিনি কিছুতেই যখন রাজি হচ্ছিলেন না তখন তাকে বিবস্ত্র করে শ্লীলতাহানির ভিডিও ধারণ করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত নারী পুলিশকে জানায়, অভিযুক্তরা তাদের টিনের ঘরের দুর্বল দরজা বাইরে থেকে লাথি দিয়ে ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তখন ওই নারীর স্বামীকে বেধরক পিটিয়ে ঘরের এক পাশে ফেলে রাখে। এরপরই ঘরে বর্ণনাতীত সেই লোমহর্ষক ঘটনা।
উল্লেখ্য, গত ২ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকার নূর ইসলাম মিয়ার বাড়িতে গৃহবধূর বসতঘরে ঢুকে তার স্বামীকে পাশের কক্ষে বেঁধে রাখে স্থানীয় বাদল ও তার সহযোগীরা। এরপর গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করে তারা। এ সময় গৃহবধূ বাধা দিলে তারা বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধর করে মোবাইলে ভিডিও চিত্র ধারণ করেন।
এ ঘটনায় ৫ অক্টোবর দিবাগত রাত ১টার দিকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে নির্যাতিতা গৃহবধূ (৩৫) বাদী হয়ে পর্নোগ্রাফি আইনে ৯ জনের নামে বেগমগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। ঘটনার ৩৩ দিন পর গত ৪ অক্টোবর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
মামলায় এখন পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে গেল সোমবার সকালে মামলার ১নং আসামি বাদলকে ঢাকা থেকে ও স্থানীয় দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং লিডার ও দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক করে র্যাব-১১।
আটক বাদল (২২) একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মধ্যম একলাশপুর গ্রামের মোহর আলী মুন্সিবাড়ির রহমত উল্যার ছেলে, দেলোয়ার একই গ্রামের কামাল উদ্দিন ব্যাপারী বাড়ির সাইদুল হকের ছেলে।
একই মামলায় একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের খালপাড় এলাকার হারিদন ভূঁইয়াবাড়ির শেখ আহম্মদ দুলালের ছেলে মো. রহীম (২০) ও একই এলাকার মোহর আলী মুন্সিবাড়ির মৃত আবদুর রহীমের ছেলে মো. রহমত উল্যাহকে (৪১) গ্রেফতার করে পুলিশ।
সবশেষ গতকাল সোমবার রাতে অভিযুক্ত একলাশপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন সোহাগকে (৪৮) এলাকা থেকে এবং রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে মামলার ৫ নম্বর আসামি মো. সাজুকে (২১) গ্রেফতার করা হয়েছে।