নিজস্ব প্রতিবেদক | নরসিংদী প্রতিদিন:
সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানো হয়েছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে স্বপ্নের পুরো পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের ৫ বছর পূর্তির দুই দিন আগে খুঁটির ওপর বসেছে সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান।
এর মধ্য দিয়ে সেতুর মূল অবকাঠামো শতভাগ দৃশ্যমান হলো। বাস্তবে ধরা দিলো স্বপ্ন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এই সেতু দিয়ে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগের পথ তৈরি হলো।
এরপর দ্বিতল এই সেতুর ঢালাইয়ের কাজ, অ্যাপ্রোচ রোড ও ভায়াডাক্ট প্রস্তুত করা, রেলের জন্য স্ল্যাব বসানো হয়ে গেলেই স্বপ্নের পদ্মাসেতু যানবাহন চলাচলের উপযোগী হবে। আর এক বছরের মধ্যেই সেতুটি চালু করা যাবে বলে ইতোমধ্যে আশা প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাওয়া প্রান্তে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির ওপর সর্বশেষ ৪১তম স্প্যানটি বসানো হয়। ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এ স্প্যানটি স্থাপিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মিলিত হলো প্রমত্ত পদ্মার দুই তীর। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পথও উন্মুক্ত হওয়ার পথে।
পদ্মাসেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুর কাদের গণমাধ্যমকে জানান, গত শুক্রবার পদ্মা সেতুর ৪০তম স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে ছয় কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়। ৪১তম স্প্যানটি বসাতে বুধবারই সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়।
৩২০০ মেট্রিক টন ওজনের ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যানটি মাওয়ার কুমারভোগের কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে নিয়ে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির কাছে পৌঁছে যায় ভাসমান ক্রেইন ‘তিয়ান ই’। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইঞ্চি মেপে শুরু হয় স্প্যান স্থাপনের কাজ।
যে ৪১টি স্প্যান দিয়ে পুরো পদ্মাসেতু তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি বসানো হয়েছে, আর মাওয়া প্রান্তে বসানো হয়েছে ১৯টি স্প্যান। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান। মোট ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মাসেতু তৈরি হচ্ছে।
মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি কোম্পানি সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
পদ্মাসেতুর যাত্রাপথ সহজ ছিল না। বলা হয় দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের পর সবচেয়ে খরস্রোতা নদী পদ্মা। প্রতিটি কাজে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তাই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বের প্রথম স্প্যান বসলেও পুরো ৪১টি শেষ করতে লাগল তিন বছর তিন মাস।
এর আগে ২০১৪ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল পদ্মাসেতুর। শুরুতে একেকটি স্প্যান বসাতে সময় লেগেছিল কয়েক মাস। তবে গত দুই মাসে আটটি স্প্যান ও এ মাসে একটি স্প্যান বসানোর মাধ্যমে প্রকৌশলীরা কাজের অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
ভরা বর্ষায় তীব্র স্রোত মোকাবেলা করে পাইলিং করতে হয়েছে। আবার শীতে অত্যধিক পলি অপসারণ করতে দিনরাত কাজ করেছে ড্রেজার। মাটির তলদেশের গঠনগত ভিন্নতার কারণে পাইলিং লেগেছে অতিরিক্ত আট মাস। এ কারণে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সেতু চালুর টার্গেট থাকলেও পূরণ হয়নি। এর ওপর করোনার কারণে অগ্রগতি কমে আরও ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ।
পদ্মাসেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। ১৯৯৮ সালে প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই দিয়ে এই অপেক্ষার শুরু। এর মাঝখানে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে জটিলতা স্বপ্নের সেতুর ভবিষ্যৎই শঙ্কায় পড়ে যায়। এর মধ্যে সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর ২০১৪ সালে মূলসেতুর কাজ শুরু হয়। অবশ্য জমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এর আগেই শুরু হয়েছিল। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শুরুর পর অবশ্য নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে। কখনো পদ্মার ভাঙন, আবার কখনো কারিগরি জটিলতায় কাজ আটকে গেছে। পরিবর্তন করতে হয়েছে নকশায়। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি।
২০১৭ সালে পদ্মাসেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। সপ্তাহখানেক পর দেশে ফিরে এলে বিমানবন্দরে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সময় রাত তিনটায় স্প্যান বসানোর খবর পান জানিয়ে ওই দিন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ওবায়দুল কাদের মেসেজ পাঠাল, তার সচিবও মেসেজ পাঠাল যে সুপার স্ট্রাকচারটা বসে গেছে। আমি বললাম, আমাকে ছবি পাঠাও।
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ছবি এবং ভিডিও ক্লিপ পাঠাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমরা দুই বোন ওখানে কেঁদেছিলাম। রেহানা, আমি...কী যে অপমান, কত কিছু যে হয়েছে, তা বলার মতো না।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘পদ্মাসেতু যে নিজেদের টাকায় করতে পারব; তা অনেকে বিশ্বাস করতে পারেনি। অনেক সিনিয়র কেবিনেট মেম্বাররাও বিশ্বাস করতে পারেনি। সবাই বলতেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ছাড়া কেউ করতে পারবে না। আমি বলতাম, যত দিন না নিজেরা করতে পারব, তত দিন করবই না।’
এবার শেষ স্প্যান বসানোর দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সবাই দেশে। তবে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটি উদ্যাপনের বড় কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়নি।
সেতু বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি না হলে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল। তবে সুবিধামতো সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়তো হেলিকপ্টারে সেতুর ওপর দিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।
কাজ যেভাবে এগিয়েছে: মূল সেতুর কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের নভেম্বরে। কাজ পেয়েছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। তাদের সঙ্গে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল।
কাজ শুরুর পরের বছরই মাওয়ায় স্থাপিত নির্মাণ মাঠের বেচিং প্ল্যান্টসহ একাংশ নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সালে প্রতিটি খুঁটির নিচে মাটি পরীক্ষায় ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া যায়। তখন নকশা সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফেরিঘাট স্থানান্তরেও সময়ক্ষেপণ হয়।
শুরুতে প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি বসানো) বসানোর পরিকল্পনা ছিল। যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। এ জন্য খুঁটি নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়।
সব মিলিয়ে এই কাজে প্রায় এক বছর বাড়তি লাগে। এ জন্য মাঝে কাজে কিছুটা গতি হারায়। ঠিকাদারকে ২ বছর ৮ মাস বাড়তি সময় দেয়া হয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
নদীশাসনের কাজও শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল চার বছরে। ২০১৭ সালের দিকে স্রোতের কারণে মাওয়ায় নদীর তলদেশে গভীর খাদ তৈরি হয়।
এছাড়া মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ভাঙনও দেখা দেয়। ফলে নদীশাসনের কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। এখন আড়াই বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত নদীশাসনের কাজ শেষ হয়েছে ৭৬ শতাংশ।
দুই পারে সংযোগ সড়ক, টোল প্লাজা ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ আগেই শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনও সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
ব্যয় ও সেতুর প্রভাব: ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মাসেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা।
২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।
পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে যেমন প্রভাব ফেলবে, সহজ হবে মানুষের চলাচলও।
এদিকে কোনও ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নেতার নামে নয়, নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর নামকরণ করা হবে পদ্মা নদীর নামেই। তাই নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুটি বাংলাদেশ তথা বিশ্ববাসীর কাছে ‘পদ্মাসেতু’ নামেই পরিচিত হবে।
বুধবার (৯ ডিসেম্বর) সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, দেশের বৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতুর নাম কী হবে তা নিয়ে নানা মহলে চলছে আলোচনা।
বিভিন্ন মহল থেকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মওলানা ভাসানী, কবি সুফিয়া কামাল, জীবনানন্দ দাসের নাম অনুসারে সেতুর নামকরণের দাবি তোলা হচ্ছে। তবে সরকার কোনও ব্যক্তির নামে এই সেতুর নাম না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।