কোটা সংস্কারের জন্য তীব্র আন্দোলনের মুখে সব ধরনের কোটা ব্যবস্থা তুলে দেয়ার ঘোষণা আসে দুই বছর আগে। কোটা নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুলাইমান হোসাইন বলেন, ‘আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্জনের ইতিহাস অন্য দেশের তুলনায় ব্যতিক্রম। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ঐকান্তিক ত্যাগেই এই দেশ দ্রুত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দেশের সরকারি সেক্টরগুলোতে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্ম না থাকে তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বলার মতো একসময় কেউ না-ও থাকতে পারে। এমন অবস্থা যেন না হয় সেই জন্যই সরকারি চাকরি বা প্রশাসনসহ সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অগ্রাধিকার বা কোটা ব্যবস্থা বহাল ও চালু করা হোক। ১৯৭২ সালে যখন প্রথম কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয় তখন বলা হয়েছিল যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যে ক্ষতির সন্মুখীন হয়েছিল, সেটা যেন তারা পুষিয়ে নিতে পারে। ’৭৫-এর পর থেকে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা সংসদ থেকে শুরু করে সব জায়গায় ছিল। সে সময় এসব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন না করায় সারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাং এমন পরিস্থিতির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্যই আমাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে সরকারি চাকরি বা প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা চাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মানিকুর রহমান মানিক বলেন, ‘২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়। আমি মনে করি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখা জরুরি। তাদের সম্মানে ৩০% না হলেও কোটা রাখার দরকার।’
এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আশেক আহমেদ নিপুণ বলেন, ‘যারা মেধাবী তারা কখনো কোটার জন্য বসে থাকবে না। যাদের নিজের ওপর বিশ্বাস থাকে না তারা কোটার খোঁজ করে। কোটা অসহায়দের জন্য হওয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে কথা হয় কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে আলোচনায় আসা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা যে আন্দোলনটা করেছিলাম সেটা ছিল ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেরর মধ্য দিয়ে। যদিও আমাদের আন্দোলনকে জামায়াত-বিএনপির আন্দোলন বলে আখ্যায়িত করে দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ দেয়া হয়েছিল। তবু আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখা যায়নি। আমরা তো কোটা বাতিল চাইনি। চেয়েছিলাম সংস্কার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটি একেবারেই তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ঘোষণা বা সিদ্ধান্তটা ছিল রাজনৈতিক। যাই হোক মিথ্যা মামলা ও হামলার মাধ্যমে এখন একটা সংগঠন করেছি, যেটা এখন মানুষের কথা বলবে।’
তিনি বলেন, ‘নানা নাটকীয়তার পরে, এভাবে ঘোষণা দিয়েও কিন্তু কোটা তুলে দেয়া হয়নি। অক্টোবরের দিকে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করা হয়েছে কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে এখনো কোটা রয়েই গেছে। সরকার আসলে কারো দাবিই মানেনি।’
যারা কোটা বহালের দাবিতে আন্দোলন করছে তাদের ব্যাপারে কি বলবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নুর বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের মতো যেসব সংগঠন এই আন্দোলন করছে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি করে মাঠ দখল করতে চায়। এটা খুবই দুঃখজনক যে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিরা যখন এদের সঙ্গে আন্দোলনের কথা বলেন, তখন আর কিছু বলার থাকে না। প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিল করে দেয়ার পরেও তারা সেটা বহাল রাখার জন্য আন্দোলন করছেন। তাহলে কি বিষয়টা স্ববিরোধী হয়ে গেল না?’
মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানরা কি কোটা পেতে পারেন না তাহলে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দেখুন মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা বিষয়কে আমাদের দেশে নানাভাবে বিতর্কিত করা হয়েছে। ’৭১-এ যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তারা কেউ সুবিধা লাভের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে নাই। তারপরও রাষ্ট্র তাদের একটা সন্মান দিতে পারে এবং সে সন্মান দেয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটা দেয়া যেতে পারে। সেটাও সব মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের প্রয়োজন নেই। এমনো মুক্তিযোদ্ধা আছেন যার ঢাকায় প্লট, ফ্ল্যাট রয়েছে, গ্রামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তার ছেলের তো কোটার দরকার নেই। মুক্তিযোদ্ধা কোটা কারা পাবে? সেটা আগে নিশ্চিত করতে হবে, সংজ্ঞায়িত করতে হবে। ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু যে বিবেচনায় কোটা করেছিলেন, অর্থাৎ অসহায়, পঙ্গু ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য। যদি কোটা পঞ্চাশ পার্সেন্টও করা হয় আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যেটা দেখছি যে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সাজানো হচ্ছে, যাদের বয়স সাতচল্লিশ বছর তারা মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে বারবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে কাটছাঁট করা হচ্ছে। এখন তো মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ণয় করাই কঠিন হয়ে গেছে। সুতরাং কোটার ব্যবহারের কারণে সেগুলো আরো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জীবিত ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত মৌলিক চাহিদার দায়ভার যদি সরকার নেয়, তাহলে সব থেকে বেশি ভালো হয়। আসলে অযোগ্যদের কোটার মাধ্যমে চাকরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসিয়ে লাভ হবে না। যোগ্যতা না থাকলে কোটা দিয়ে কাউকে বেশি দূর নিয়ে যাওয়া যায় না। যাদের যোগ্যতা ও মেধা রয়েছে তারা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এদিয়ে আসুক। অযোগ্যদের কোটার মাধ্যমে প্রাধান্য দিলে তো বাস্তবতায় সেটি খাপ খাবে না। আমার মনে হয় চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বিষয়টাকে সামনে না এনে অন্যভাবে অনগ্রসরদের সহায়তা করা যায়, সেটা ভাবা উচিত। কোটার বিকল্প ভাবা উচিত এখন।’