দূর আকাশের তারা হয়ে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্র, টিভি নাটকের প্রবীণ অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকার এটিএম শামসুজ্জামান। তার চলে যাওয়ায় দেশের তারকা অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমেছে। গুণী এ অভিনেতার চিরবিদায়ে সারা দেশে চলচ্চিত্রপ্রেমী ও তার অগণিত ভক্ত-দর্শক-শুভাকাঙ্ক্ষিদের মনে শোকের কালো মেঘ ভিড় করেছে। কিন্তু মৃত্যুকে চিরন্তন সত্য জেনে একদিন তো সবাইকেই যেতে হয়। তবে কিছু মৃত্যু, কিছু চলে যাওয়া দাগ কেটে যায় মানুষের মনে। তেমনই একজন অমর অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান।
১৯৬০ এর দশক থেকে চার শতাধিক চলচ্চিত্রের বহু খল ও কমেডি চরিত্রকে অমর করে যাওয়া এ অভিনেতা শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সঙ্গে যার নামটি যুগ যুগ উচ্চারিত হচ্ছে তিনি এটিএম শামসুজ্জামান। অভিনেতা পরিচয়ের বাইরে একাধারে একজন পরিচালক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার হিসেবেও তিনি ছিলেন সমানভাবে সফল। মঞ্চের অভিনয় দিয়ে যাত্রা শুরুর পর কমেডি অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে পা রেখেছিলেন। এরপর খল চরিত্রে তার দুর্দান্ত অভিনয় এখনও জীবন্ত হয়ে আছে।
এ টি এম শামসুজ্জামান ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড়বাড়ি আর ঢাকায় থাকতেন পুরান ঢাকার দেবেন্দ্র নাথ দাস লেনে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পোগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহী লোকনাথ হাইস্কুলে। তার বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। মা নুরুন্নেসা বেগম। ৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে এ টি এম শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।
চলচ্চিত্রে হাস্যরসের ছলে কূটচালের জন্য তার জুড়ি মেলা ভার। একটা সময় তাকে ঘিরেই চিত্রনাট্য লেখা হতো। খল চরিত্রে তিনিই ছিলেন নির্মাতাদের সেরা ভরসা। এরপর ক্রমে কৌতুলপ্রধান চরিত্রে ঝুঁকে পড়েন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসির সংলাপে দেখা যেতো তাকে। এখানেও তার চরিত্রগুলো অমর হয়ে আছে।
রুপালি পর্দার বাইরে টেলিভিশন নাটক ও টেলিফিল্মেও সমানভাবে ছাপ রেখে গেছেন এ টি এম শামসুজ্জামান। চলচ্চিত্র ‘টক ঝাল মিষ্টি’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘জামাই শ্বশুর’, ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, নাটক ‘পত্র মিতালী’সহ অনেক জনপ্রিয় চরিত্রের নন্দিত অভিনেতা তিনি।
কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’ ও ‘মন বসে না পড়ার টেলিবে’ তার অভিনীতি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। খল চরিত্রে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে ‘অশিক্ষিত’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ও ‘স্বপ্নের নায়ক’ অন্যতম। পার্শ্বচরিত্রে ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’ ও ‘চোরবালি’ ছবিতে দুর্দান্ত ছিল তার অভিনয়।
১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে এ টি এম শামসুজ্জামানের চলচ্চিত্র জীবনের পথচলা শুরু। প্রথম কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘জলছবি’ সিনেমার জন্য। ওই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। এ ছবির মাধ্যমেই অভিনেতা ফারুকের চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে।
এছাড়া খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তদের মতো নির্মাতাদের সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন এ টি এম শামসুজ্জামান। ২০০৯ সালে পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটির ‘এবাদত’ নামের একটি চলচ্চিত্র। একজন কাহিনিকার হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনি লিখেছেন এ টি এম শামসুজ্জামান। প্রথম দিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শুরু করলেও অভিনেতা হিসেবে রুপালি পর্দায় আসেন ১৯৬৫ সালের দিকে। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। ১৯৮৭ সালে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দায়ী কে?’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘আজীবন সম্মাননা’ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
ষাটের দশকের টিভি নাটকে তার পথচলা শুরু হয়। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাকটগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘ঘর কুটুম’, ‘বউ চুরি’, ‘নোয়াশাল’ ও ‘শতবর্ষে দাদাজান’।
সবকিছুকে ছাপিয়ে চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান এ টি এম শামসুজ্জামান। একাধারে কৌতুক অভিনেতা, খল অভিনেতা ও পার্শ্বচরিত্রে তিনি দারুণ সফলতা দেখিয়েছেন।
খ্যাতিমান এ অভিনেতার উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো মধ্যে ‘মলুয়া’, ‘বড় বউ’, ‘অবুঝ মন’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘শ্লোগান’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘সংগ্রাম’, ‘ভুল যখন ভাঙলো’, ‘চোখের জলে’, ‘লাঠিয়াল’, ‘অভাগী’, ‘নয়নমণি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘পুরস্কার’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, ‘রামের সুমতি’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘দায়ী কে?’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘দোলনা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘অজান্তে’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘তোমার জন্য পাগল’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘জামাই শ্বশুর’, ‘আধিয়ার’, ‘শাস্তি’, ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’, ‘দাদিমা’, ‘আয়না’, ‘ডাক্তার বাড়ি’, ‘চাঁদের মতো বউ’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’, ‘এবাদত’ ও ‘বিশ্বাস’ ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র।