প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালির ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্যই আন্দোলন ছিলনা বরং এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষা আন্দোলন (ভিত্তিক) নয় এই ভাষা আন্দোলন আমাদের বাঙালি জাতি হিসেবে সার্বিক অর্জনের আন্দোলন।
’৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনারে জাতির পিতা প্রদত্ত ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেটা আমাদের করে দিয়ে গেছেন, যেটা ধরে রেখে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে এসব কথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এ্যভেনিউতে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।’ তিনি বলেন, ’৫২ এ রক্ত দেওয়ার পরেই বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছিল তা কিন্তু নয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারেও যেমন এই রাষ্ট্রভাষার কথা বলা হয়েছিল এবং ’৭০ এর নির্বাচনেও এই রাষ্ট্রভাষার কথা আসে। কারণ ’৫৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন যে শাসনতন্ত্র করা হয় তাতে উর্দ্দুর সংগে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭০ নির্বাচনের পরে ’৭১ এ আমরা যখন মুক্তিযদ্ধে বিজয় অর্জন করি এবং জাতির পিতা আমাদের যে সংবিধান দেন সেখানে বাংলা ভাষাই ছিল রাষ্ট্রীয় ভাষা। সেই মর্যাদাটাই আমরা পাই। তিনি বলেন, ’৫৬ সালে শহীদ মিনার তৈরী করা, ২১ শে ফ্রেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়া-এসব কিছু তখন আওয়ামী লীগই করে। ’৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনশনরত অসুস্থ বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে বের করে তার দাদা টুঙ্গিপাড়া নিয়ে গেলেও সুস্থ হয়ে ফিরেই পুনরায় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আবারো আন্দোলন শুরু করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবি তখন জাতির পিতা তার বিভিন্ন ভাষণে করে গেছেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য পাকিস্তানি ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ সিরিজের বইগুলো পড়ে দেখার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি চাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এটা পড়বেন। তাছাড়া যারা গবেষণা করেন তাদেরকে বলবো মহামূল্যবান দলিল আপনারা এখানে পাবেন।’
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী অনুষ্ঠানে প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন। অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তৃতা করেন- আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, শিক্ষা এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাপা, সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, মহানগর উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ আলোচনা সভাটি গণভবন থেকে সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘পাকিস্তানের ইন্টালিজেন্স ব্রাঞ্চের গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে প্রকাশিত বইগুলো যদি আপনারা পড়েন। ’৪৮ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত এ পর্যন্ত ৭ খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ভাষা আন্দোলনকালে কবে কোন লিফলেট তৈরী করে তিনি বিলি করেছেন, কোন বক্তৃতায় ভাষার কথা বলেছিলেন, কাদের নিয়ে পুনরায় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ করা হয়েছিল, কিভাবে আবার তিনি সংগ্রাম করেছিলেন এবং বারংবার গ্রেফতার হন তার সমস্ত তথ্য আপনারা সেখানে পাবেন। তিনি বলেন, এই রিপোর্ট জাতির পিতার পক্ষে নয়, ছিল বিপক্ষে প্রণীত এবং তারা তাদের ক্ষোভের বশে এটা করেছে। কারণ জাতির পিতা যেসব কাজ করছেন তা পাকিস্তানীদের পছন্দনীয় ছিল না। আর এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ইতিহাস জানতে পারি, মহামূল্যবান তথ্য জানতে পারি। যেকারণে আমি এটা প্রকাশ করেছি। আমি জানিনা পৃথিবীর আর কোন দেশে তাদের নেতার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট এভাবে বই আকারে প্রকাশ হয়েছে কিনা, হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ৪৬টি ফাইলে ৪৮টি খন্ড পাওয়া গিয়েছিল। যেখানে পাতার সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার পাতা। প্রায় ২০ বছর তিনি তার প্রয়াত বান্ধবী সাংবাদিক বেবী মওদুদকে নিয়ে এই বইয়ের জন্য কাজ করেছেন এবং তথ্য উদ্ধারে স্পেশাল ব্রাঞ্চেরও সহযোগিতা নিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা রেখেছি। এটা শুধু আমাদের নয় সমগ্র পৃথিবীতে যাদের মাতৃভাষা রয়েছে তাদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য এবং এর ওপর যেন গবেষণা হতে পারে সেজন্য আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছি। সেখানে ভাষা, জাদুঘর করেছি, আর্কাইভও করা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ওপর একটা মহান দায়িত্ব পড়ে গেছে সারাবিশ্বের ছোট, বড় যত ভাষাভাষি বা মাতৃভাষা রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করার, সেখানে রাখার এবং গবেষণার সুযোগ করে দেয়ার। পৃথিবীতে কিন্তু মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য এই একটিই এতবড় ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলা হয়েছে। আর কোথাও এর দৃষ্টান্ত নেই।’
তিনি বলেন, তার সরকার এটি করতে পারায় আমাদের শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি এবং বৃথা যেতে পারেনা, এটাই প্রমাণিত সত্য। শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি তাঁকে অর্থবহ করে তুলতে হলে এর সুফল দেশের সব মানুষের ঘরে পৌঁছে দেব-এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা। তিনি ২০০১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার এর নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখায় তাদের কঠোর সমালোচনা করেন।
জাতির পিতার কন্যা ‘মুজিববর্ষ’ এবং ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে’ সামনে রেখে এই দুটি উদযাপনকালে দেশের সব গৃহহীণকে অন্তত একটি ঘর করে ঠিকানা গড়ে দেওয়ার এবং শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে দেশের সকল ঘরকে আলোকিত করায় তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি এ সময় করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়া হলেও মাস্ক ব্যবহার করা, হাত পরিস্কার করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় চলার মত কোভিড-১৯ প্রতিরোধ মূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেও দেশবাসীর প্রতি তাঁর আহবান জানান।
এরআগে অনুষ্ঠানের শুরুতে ’৫২র মহান ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগ স্মরণে সকলে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতাও পালন করেন।