উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ অবশ্যই আমাদের জন্য গর্বের এবং এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার বিকেলে গণভবন থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ গতকাল (২৬ ফেব্রুয়ারি) স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি। সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের। আমাদের এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটলো, যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি; আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে।’
বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি।’
এই অর্জনকে দেশের নতুন প্রজন্মকে উৎসর্গ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে। আমাদের এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য এটি একটি বিশেষ ধাপ।’
শেখ হাসিনা বলেন, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকের ভিত্তিতে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের তিনটি মানদণ্ডই খুব ভালোভাবে পূরণ করে। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ পুনরায় সকল মানদণ্ড অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পূরণের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী জীবনের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর আমি ব্যাপকভাবে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা সফর করি। আমি সে সময়ই প্রতিজ্ঞা করি যদি কোনদিন আল্লাহ আমাকে সুযোগ দেন দেশ পরিচালনার, তাহলে গ্রামের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। গ্রামের মানুষের উন্নয়নে কিছু করার। তখন ৭০-৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করতো। আমার মনে হয়েছিল এদের যদি দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে জনগণের রায় নিয়ে আমি প্রথমবার সরকার গঠন করে আমার চিন্তা-চেতনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। নতুন নতুন পরিকল্পনা, কর্মসূচি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে গরিব, প্রান্তিক মানুষদের সরকারি ভাতার আওতায় নিয়ে এসেছি। কৃষি উৎপাদনের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম। মাঝখানে ৫ বছর বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় ছিল। তারা কী করেছিল আপনারা জানেন। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়ে আমরা অব্যাহতভাবে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আজকের যে উন্নতি, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তা আমাদের বিগত ১২ বছরের নিরলস পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার ফসল। দেশের মানুষই এসব করেছেন। আমরা সরকারে থেকে শুধু নীতি-সহায়তা দিয়ে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল গৃহহীনদের ঘর প্রদান কর্মসূচির আওতায় ৮ লক্ষ ৯২ হাজার গৃহহীনকে ঘর প্রদান করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৭০ হাজার ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৫০ হাজার গৃহ নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৬ পরিবারকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি খাতে চলতি বাজেটে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা বাজেটের ১৬ দশমিক আট-তিন শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক শূন্য-এক শতাংশ। উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি, উপবৃত্তি প্রদান করা হয়।
প্রসঙ্গত, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হতে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এলডিসি স্ট্যাটাস পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ, নেপাল ও লাওসকে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের সুপারিশ করা হয়।