করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বছরপূর্তি আগামী ১৭ মার্চ। এক বছর আগে একসঙ্গে বন্ধ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলছে দুই ধাপে। ৩০ মার্চ এ প্রক্রিয়া শুরু হবে, শেষ হবে ২৪ মে। এক মাসের মধ্যে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শেষ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ চলবে দু’মাস ধরে। আর খোলার দু’মাসের মধ্যে স্কুল কলেজে কোনো পরীক্ষা হবে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই প্রস্তুতির অংশ হিসাবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া হবে। এজন্য ১২ লাখ টিকা ‘রিজার্ভ’ (সংরক্ষণ) রাখা হয়েছে। পুরোদমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর আগে স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। ২৪ মের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থী ফিরবে ক্লাস রুমে। আপাতত ৪ বছর বয়সি প্রাক-প্রাথমিক স্তরের অর্ধ কোটি শিক্ষার্থী স্কুলে যাবে না।
এবারের এসএসসি পরীক্ষা জুলাইয়ের মধ্যে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য ৩১ মার্চ থেকে শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের কাজ শুরু হবে। এসএসসির ২ মাস পর হতে পারে এইচএসসি পরীক্ষা। জেএসসি নাও হতে পারে। তবে পিইসি পরীক্ষা নভেম্বরেই নেয়ার কথা ভাবছে সরকার।
জানা গেছে, এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন এবং মুদ্রণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। যদিও পরীক্ষার আগে বিশেষায়িত সিলেবাসের ওপর ৬০ কর্মদিবস শ্রেণি কাজ করা হবে। মাঝখানে আছে রমজান ও ঈদ। এ কারণে পরীক্ষা জুলাইয়ের পরও দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। এসএসসি জুলাইয়ে শুরু না হলে এইচএসসিও পেছাবে।
সেই হিসাবে আগস্টে এসএসসি হলে এইচএসসি অক্টোবরে চলে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে এবার জেএসসি পরীক্ষা নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। সে কারণেই ২৭ ফেব্রুয়ারির ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জেএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাসসংক্রান্ত আলাদা কোনো নির্দেশনা দেননি। তারাও প্রথম থেকে চতুর্থ এবং ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মতো একদিন স্কুলে যাবে।
এমনকি নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে দুদিন ক্লাসে থাকতে হবে। তবে শিক্ষা বোর্ডগুলো ৩০ মার্চের পর অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিবন্ধন কাজ সেরে রাখবে। অন্যদিকে জেএসসি না হলেও পিইসি পরীক্ষা নভেম্বরেই নেয়ার চিন্তা আছে সরকারের। যে কারণে তাদের সপ্তাহে ৫ দিন স্কুলে নেয়ার পরিকল্পনা আছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সপ্তাহে ৬ দিন করে স্কুল-মাদ্রাসায় যাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, খোলার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা কীভাবে পরিচালিত হবে সে সংক্রান্ত বিস্তারিত নির্দেশনা (গাইডলাইন) আমরা পাঠিয়েছি। সেটা অনুসরণ করে শ্রেণি ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সে অনুসারে খোলার দুই মাসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো পরীক্ষা হবে না।
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ন্যূনতম ৬০ দিন আর এইচএসসিতে ৮৪ দিন ক্লাস হবে। ক্লাস শেষ হওয়ার পর কমপক্ষে দুই সপ্তাহ দেয়া হবে প্রস্তুতির জন্য। এরপর পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা দুটি নেওয়া হবে। নিরবচ্ছিন্ন একাডেমিক কাজের স্বার্থে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের টিকা দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, প্রথমে ৩০ মার্চ উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা খুলে দেয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে চাঞ্চল্য ফিরবে একই পর্যায়ের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। পরে ২৪ মে খুলবে উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর এক সপ্তাহ আগে অবশ্য খুলে দেয়া হবে আবাসিক হলও।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. এসএম আমিরুল ইসলাম বলেন, স্কুল খোলার পরদিন থেকেই আমরা এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ কাজ শুরু করব। অন্য বছর এক সপ্তাহ সময় দেয়া হয়। এবার ১০-১২ দিন দেয়া হবে।
তিনি বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরিশোধন এবং মুদ্রণ কার্যক্রম আমরা শুরু করেছি। নির্ধারিত সংখ্যক ক্লাস এবং মাঝখানে থাকা ছুটির পর জুলাইয়ে যদি পরীক্ষা নেয়া যায় নেয়া হবে। নইলে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস পেছাতে পারে। একই বিষয়ে বোর্ডের সচিব অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, সাধারণত দুই মাস গ্যাপ দিয়ে আমরা এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে থাকি।
জুলাইয়ে এসএসসি শুরু করতে পারলে সেপ্টেম্বরে এইচএসসি শুরু করা হবে। তিনি আরও বলেন, জেএসসি পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি। তবে আমরা তাদের নিবন্ধন শেষ করে রাখব।
এদিকে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আসবাবপত্র বিশেষ করে আবাসিক হলগুলো বসবাসের অনুপযোগী হওয়ার আশঙ্কা করছে সরকার। এজন্য খোলার প্রস্তুতি হিসাবে হল সংস্কার করতে বলেছে। এ কাজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। ইউজিসির মাধ্যমে এ টাকা পৌঁছে দেয়া হবে।
ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, দেশের ৪৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২০টি আবাসিক হল আছে। সেগুলোতে ১ লাখ ৩২ থেকে ৩৫ হাজার আবাসিক ছাত্রছাত্রী আছেন। এক বছর হল বন্ধ থাকায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। বরাদ্দের টাকায় কাজ শেষ না হলে বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব তহবিলের অর্থে কাজ শেষ করবে। কেননা সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এ খাতে বাজেটে কম-বেশি বরাদ্দ থাকে।
প্রস্তুতির অংশ হিসাবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দিতে ২৭ ফেব্রুয়ারির আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকেই শিক্ষা বিভাগের জন্য ১২ লাখ টিকা রিজার্ভ রাখার পরামর্শ আসে। আপাতত আড়াই মাসে প্রায় ১১ লাখ তালিকাভুক্ত জনবলকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ১২ লাখ টিকাই দরকার হবে। কেননা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে ৫ লাখ টিকার চাহিদা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে আছে মাধ্যমিক স্তরের সরকারি ও বেসরকারি এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী। এর বাইরে সরকারি কলেজের ১৫ হাজার শিক্ষক আছেন।
আছেন মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী। এক্ষেত্রে আরও ১ লাখের বেশি টিকা দরকার হবে। অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরেও একই ধরনের ৫ লাখ জনবলকে টিকা দেয়া হবে। এর মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষককে টিকা দেয়া শেষ হয়েছে।
এছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২০ আবাসিক হলে ১ লাখ ৩২ থেকে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ হাজার ৬শ’ এবং বেসরকারিতে ১৬ হাজার ৮৭ জন শিক্ষক আছেন। এর বাইরে ২ লাখের কিছু বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন।
এদের অনেকে সাধারণ কোটায় টিকা নিয়েছেন। ৪০ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের জন্য শুধু বিশেষ ব্যবস্থা আয়োজন করা হবে। তবে চল্লিশোর্ধ্ব অনেকে সাধারণ কোটায় টিকা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান।
সূত্র জানিয়েছে, সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২০ আবাসিক হলের ছাত্রছাত্রীকে টিকা দিতে চাচ্ছে। তাতে ১ লাখ ৩২ থেকে ৩৫ হাজার জন টিকা পাবেন। তবে সর্বনিম্ন ১৮ বছর বয়সিরা টিকা পাবেন বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, এজন্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর (এনআইডি) চাওয়া হয়েছে।
ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, আমরা ২৫ ফেব্রুয়ারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। সবার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর চেয়েছি। সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ইমেইলে তারা তথ্য পাঠাতে পারেন। এর অনুলিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিতে পাঠাবেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের তথ্য আলাদা দুটি ছক তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, পদবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, জন্ম তারিখ, জেলা ও উপজেলার নাম পাঠাতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পদবির জায়গায় শিক্ষার্থীর নাম ও শ্রেণি/বর্ষ, বিভাগ, হলের নাম ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে।