ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক-অশুল্ক বাধা একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি ও কাউন্টারভেইলিং ডিউটি আরোপ করে রেখেছে দেশটি। ব্যবসায়ীদের জন্য সহজে ভিসা প্রাপ্তি একটি বড় সমস্যার নাম। এজন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানের ব্যাপারে এবার এক টেবিলে বসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত।
মহান স্বাধীনতার ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার (২৬ মার্চ) দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন। এসময় দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অবকাঠামোখাত উন্নয়নে তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) চুত্তি করার কথা রয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বৃহৎ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে শীঘ্রই (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-সিপা) সিপা চুক্তি করার কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ পর্যায়ের ওই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলো দ্রুত সমাধানে আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ওই সময় অন্তত্ব ছয় থেকে আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্বারক সই করা হতে পারে। এলক্ষ্যে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ।
মোদির উপস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব ধরনের বাধা দ্রুত দূরীকরণে ‘বিজনেস রেমিডিয়াল মেজারস’ শীর্ষক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। দুটি বর্ডার হাট উদ্বোধন করা হবে। সবচেয়ে বেশি জোরদার দেয়া হচ্ছে বৃহৎ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সিপা চুক্তি করার বিষয়ে। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে।
এর পাশাপাশি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সহযোগিতা, করোনার ভ্যাকসিন আমদানি, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, যোগাযোগ, উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি সম্পদ, আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার পাশাপাশি সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। আলোচিত তিস্তা চুক্তি এবার করা হচ্ছে না তবে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
জানা গেছে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বন্টন ইস্যুতে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ভারতকে পাশে পাওয়া, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, ভ্যাকসিন সহযোগিতা নিশ্চিত করা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং লেটার অব ক্রেডিট এলওসি’র আওতায় ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার বিষয়গুলো আলোচনায় থাকছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠান শেষে জানিয়েছেন, ৫০ বছরের দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্কের সঙ্গে মিল রেখেই মোদির আসন্ন এই ঢাকা সফর। পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীর জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়ে আলোচনা করবে বাংলাদেশ-ভারত
ভারতের বর্তমান আমদানি বাজারের সুবিধা ঠিকমতো নিতে পারছে না বাংলাদেশ। ভারত বিশ্ববাজার থেকে অনেক পণ্য কিনছে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে নয়। একই জাতের পণ্য বিশ্ববাজারে পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু ভারতে নয়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও প্রায় অর্ধেক স্থলবন্দরগুলোর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এর জন্য নো ম্যানস ল্যান্ডে পণ্য খালাস ও উত্তোলন করতে হয়। এতে একদিকে বিলম্ব ঘটে, অন্যদিকে পণ্যের দাম চড়ে। মিউচুয়াল রিকগনিশন অ্যাগ্রিমেন্ট না থাকায় দূরবর্তী টেস্টিং সেন্টার থেকে পরীক্ষণ-সমীক্ষণের ফলাফল না আসা পর্যন্ত পণ্য পড়ে থাকে।
ঢাকা-দিল্লী পণ্য পরিবহন খরচ ঢাকা থেকে ইউরোপীয় বা মার্কিন বন্দরে পরিবহন খরচের চেয়ে অনেক বেশি। বাণিজ্য-সংযোগের কার্যকারিতা পরিবহন, বিনিয়োগ ও লজিস্টিকস কানেক্টিভিটির কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। সাফটা চুক্তির অংশ হিসেবে ভারত তার বাজারে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তা কাজে লাগাতে পারছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান সারাক্ষণকে বলেন, ‘বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই ভারতের বিকাশমান অর্থনৈতিক বন্ধনের নিরিখে সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। ঢাকা যদি সম্পর্কের সম্ভাব্য সুবিধা পুরোপুরি নিতে চায়, তাহলে তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ভারত। বড় এই দেশটির সঙ্গে যেকোন চুক্তি করার আগে এর সম্ভাব্যতা গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।’
পণ্য রফতানির পাশাপাশি সেবা রফতানি আগ্রহী বাংলাদেশ
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বৃহৎ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে শীঘ্রই (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট-সিপা) সিপা চুক্তি করা হবে। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাইলফলকে পেীঁছবে বলে মনে করছে সরকার। বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিপা) করতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেডের (আইআইএফটি) সঙ্গে একটি সমঝোতা স্বারক সই করেছে বাংলাদেশ।
দ্রুত সিপা চুক্তি করার লক্ষ্যে যৌথ সমীক্ষা তদারকির জন্য দশ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সিপা চুক্তির ফলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে কিংবা আর্থিক ক্ষতির কোন বিষয় রয়েছে কি না তা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)।
প্রাথিমিক পর্যায়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে সিপা চুক্তি করার ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চুক্তিটির পর ভারতের অবাধ বিনিয়োগ আনা সম্ভব হবে। অন্যদিকে পণ্য রফতানির পাশাপাশি সেবা রফতানি করতে পারবে বাংলাদেশ।
ঋণ চুক্তির ৩৬ হাজার কোটি টাকা চাইবে বাংলাদেশ
প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালে ভারতের সঙ্গে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই করে বাংলাদেশ। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই চুক্তির আওতায় ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প রাখা হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও ভারতের এক্সিম ব্যাংকের মধ্যে এই ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির পাঁচ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত চুক্তির আওতায় কোন ঋণ সুবিধা পায়নি বাংলাদেশ। এবার এই চুক্তির আওতায় দ্রুত ঋণ সুবিধা চাওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন সারাক্ষণকে বলেন, ‘একক দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারতের সঙ্গে বেশকিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিয়েছে। যৌথ সমীক্ষার পর সিপা চুক্তির লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এলওসি চুক্তিগুলোর ব্যাপারে ইআরডি কাজ করছে। আশা করা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে।’