“নিভছে না দিল্লির জ্বালানগর ও নিগমবোধ শ্মশানের চিতার আগুন : ফুরসত নেই জাদিদ কবরস্থানের গোর খোদকদেরও” আমরা কি প্রস্তুত?
মৃত্যুপুরী দিল্লি। জ্বলছে জ্বালানগর ও নিগমবোধ শ্মশান। চিতা জ্বলছে। গণচিতা- জ্বলছে। একের পর এক জ্বলছে। যেন অনন্তকাল ধরে জ্বলবে। পৃথিবীর সব প্রাণ যেন আত্তাহুতি দেবে এ মরণ চিতায়। শেষ অবধি নিভবে না এ চিতা – এটাই যেন ভগবানের ভেল্কি।
যেন কোন রকমে সামান্য কাঠে চলছে শবাগ্নি। ঘন, কালো ছাই-ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে দিল্লির আকাশ। নির্বিকার। নিস্তরঙ্গ। অসহায়। নিরুপায়। স্তব্ধ পুরো শহর।
হাসপাতাল যেন লাশের কোল্ডস্টোরেজ- মৃতের শেষ নিঃশ্বাস স্থল। হাসপাতালের রাস্তায় লাশ। সিঁড়িতে লাশ। করিডোরে লাশ। কেবিনে লাশ। এমনকি লিফ্টেও পড়ে আছে লাশ। মর্গেও ঠাঁই নেই। আর এসব লাশের গন্তব্য কবর-শ্মশানে।
দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে যমুনার তীরে জ্বালানগর ও নিগম বোধ শ্মশান যেন সকলের শেষ ঠিকানা। দিল্লির ঝিলমিল রোড ও রিং রোড ধরে শ্মশানমুখি শতশত লাশ। কিন্তু লাশ নিয়ে আগত পরিজন পেরেশান হয়ে দাঁড়িয়ে। রাস্তায় লাশের জট।
শ্মশানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শুধু লাশ আর লাশ। সারি সারি লাশ। যেন লাশের স্তূপ। শ্মশানের ভিতরে লাশ-বাইরেও লাশ। সৎকারের জন্য পড়ে আছে শবদেহ। সৎকারের লোকবলেরও সংকট। জায়গার সংকট। লাকড়ি/কাঠের সংকট। সংকট আর সংকট। লাশ দাহ করাও যেন এক নতুন পরীক্ষা।
এ কেমন মৃত্যু: শেষ যাত্রায় গায়ে ঘি মাখানো হয় না।চন্দন মাখানো হয় না। কানে,নাকে,চোখে,মুখে সোনা/কাঁসা দিয়ে পিন্ড দান হয় না। গাঁদা ফুলের মালা পড়ানো হয় না। পরিজন থাকে না পাশে। রোনাজারি নেই। শুধু নির্বাক-নিষ্পলক চাহনি ছাড়া আর কি বা করার আছে। আচ্ছা শবাগ্নি/মুখাগ্নির মাধ্যমে আহুতিটা অন্তত হয় কি?
হে ভগবান। এ কেমন মৃত্যু। হে ভগবান। হে ঈশ্বর। হে খোদা। মার্জনা করো। দিশা দাও।পরিত্রাণ করো!!!
নীতিশ গড়কিয়র। মধ্য বয়সী। উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী। শ্বাসকষ্ট নিয়ে দিল্লি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি ভর্তি হতে এসে সাধারণ বেডেও ভর্তি হতে পারেনি। অগত্যা তার স্ত্রী ও নাবালক পুত্র (১৫) তাকে জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।সেখান থেকে গঙ্গারাম জেনারেল হাসপাতালে এনেও বেড না পেয়ে হাসপাতালের সামনে খোলা আকাশের নিচে রেখে তার স্ত্রী অক্সিজেনের জন্য ছুটোছুটি করেন। কিন্তু কোথায় পাবে অক্সিজেন। তড়পাতে তড়পাতে জীবনের সীমানা পেরিয়ে গেলেন নীতিশ গড়কিয়র। দুই দিন অপেক্ষার পর জ্বালানগর শ্মশানে দাহের সুযোগ পায় তার পরিবার। ভাবা যায় কতটা হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি।
এই একই পরিস্থিতি দিল্লি গেটের পাশের জাদিদ কবরস্থানেও। লোকবল নেই। মাত্র বিশজন গোর খোদক বিরামহীন কেটে চলেছে একের পর এক কবর।এখন আর নতুন কবর খোঁড়ার জায়গাও নেই। লাশ পড়ে আছে রাস্তায়,পার্কে,খোলা জায়গায়। শেষ ধর্মীয় রীতি পালনও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আচ্ছা লাশের গরম-বড়ই পাতা জলে গোসল টা হয়তো। আতর, গোলাপজল, সুরমা কি দেয়া হয়। হয় কি সুযোগ মিন হা খালাকনাকুম…………
দিল্লির হাসপাতাল গুলো এখন খাঁ খাঁ করছে। ডাক্তার সংকট। নার্স সংকট। ওষুধ নেই। আইসিইউ নেই। ভেন্টিলেটর নেই। অক্সিজেন নেই। বেড নেই। নেই নেই নেই। পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। উপায়ান্তর না দেখে মসজিদ, মন্দির, মেস নাট্যশালাও রুপ নিচ্ছে হাসপাতালে। তবুও যেন করোনা নিচ্ছে না সামান্য বিরতি।
Covid-19 যেন অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ কিংবা মেরু রেখা, মহাসাগরের এপার ওপার,সীমান্ত রেখা কিছুই মানছে না। চীনের প্রাচীর পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে যেমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তেমনি বার্লিন দুর্গ ভেদ করে জার্মানিতেও চালিয়েছে তান্ডব। রক্ষা পায়নি গ্যাভ্রোডোবাসী।স্পেন-ইটালিও খেয়েছে নাকানিচুবানি। বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার স্বাস্থ্য খাতকেও এই করোনা ভাইরাস এক রকম খোজা প্রমাণ করেছে। আর উঠতি অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল করোনার প্রকোপে অসহায় হয়ে পরিত্রানের জন্য তাকিয়ে আছে শুধু অসীম আকাশের দিকে।
লাদাখ-গালোয়ান সীমানা পেরিয়ে এবার করোনা ভাইরাস যেন ঘাঁটি গেড়েছে দিল্লীতে। সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের।
ইতোমধ্যে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ও ডাবল মিউটেশন ভ্যারিয়েন্ট (ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট) এর ভয়াবহ আক্রমণের সাথে যুক্ত হয়েছে ট্রিপল মিউটেশন ভ্যারিয়েন্ট বা B.1.618। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতম হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়তই বাড়ছে লাশের সারি। দিল্লীর বাতাস জুড়ে শূধু মানুষ পোড়া গন্ধ । বৃদ্ধ, যুবা শিশু কারো যেন রেহাই নেই। ইতোমধ্যে দিল্লি হাইকোর্ট করোনার এই দুর্যোগকে “সুনামি” আখ্যা দিয়ে প্রয়োজনে ভিক্ষা করে হলেও অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে । WHO দিল্লির এই পরিস্থিতিকে ‘Beyond Heartbreaking’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
চলমান এই দুর্যোগে সেখানকার হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র অক্সিজেন সংকট। প্রাণভরে একটু অক্সিজেনের চাহিদা মেটাতে রোগী ও স্বজনদের চলছে হৃদয়বিদারক আর্তনাদ। শ্মশান-কবরস্থানে সৎকারের অপেক্ষায় সারি সারি লাশ। এসব লাশ দাহ করার জন্যও যোগান নেই পর্যাপ্ত কাঠের। পূর্ব দিল্লির ঝিলমিল ওয়ার্ডের জ্বালানগর শ্মশানে শুক্রবার দুপুরে বাইরে তখন পড়ে রয়েছে সারি সারি মৃতদেহ৷ অথচ ফুরিয়ে গিয়েছে দাহ করার কাঠ! খবর পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ঘরে মজুত কাঠ, ভাঙা চেয়ার টেবিল এমনকি কেউ কেউ ঘরের ভাঙা দরজা, জানলা পর্যন্ত তুলে নিয়ে আসেন শ্মশানে৷ সেই কাঠেই চলে একের পর দেহ সৎকারের কাজ ৷ সর্বোপরি দিল্লি (Delhi) এখন কার্যত ‘মৃত্যুপুরী’। ২৪ ঘণ্টা জ্বলছে গণ চিতা। স্থানীয় তাপমাত্রাও নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে চিতার আগুনের তাপে।
করোণার নতুন ভ্যারিয়েন্টটির উৎস পশ্চিমবঙ্গ। এর নাম “বেঙ্গল স্ট্রেইন”। করোনার ১৩০ টি জিনোম সিকুয়েন্সিং করে ১২৯ টি পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গে। ইতোমধ্যে সারা বিশ্ব ভারতকে রেড লিস্টে রেখে ভারত থেক আগমন- প্রস্থান সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে। বাংলাদেশেও সোমবার থেকে ১৪ দিনের জন্য ভারতের সাথে সকল সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
আমরা কি প্রস্তুত?…..
না আমরা প্রস্তুত নই। আমরা নির্বোধ-বেকুব। আর কতটা হলে আমরা বুঝবো? মহান আল্লাহ ক্ষমা করো!!!
এ অবস্থায় আমাদের প্রত্যেকের উচিত যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি পালন করা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়া, আর বের হলে মাস্ক পরিধান করা। মনে রাখবেন মাস্কই আসল ভ্যাকসিন।
————সকল প্রার্থনা ঐ অসীম আকাশ পানে!!!!!!!!!
…
লেখক:
মো: শাহ আলম মিয়া,
সহকারী কমিশনার (ভূমি),নরসিংদী সদর,নরসিংদী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।