মানুষ মানুষের জন্য। সমাজে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। থাকবে না শোষণ-বৈষম্য। সমান্তরাল ও স্বাভাবিক জীবন হবে সকলের। এই প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অসঙ্গতির শৃঙ্খল ভাঙার চেতনার তাড়নায় ব্যয় করেছেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। নাগরিক জীবন ও যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি শক্তহাতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ও কলমে তুলে ধরেছেন কবি শামসুর রাহমান অনবরত। যেখানেই মানুষের স্বাধীনতা হোঁচট খেয়েছে, সেখানেই ছিলেন তিনি। কবি কাউকে ভয় পায় না। সে শুধু ভয় তার কর্মকে-দায়িত্বকে। যে দায়িত্বের বিনিময়ে সে শুধু হাজারো বছরের মানুষের শ্রম ও সভ্যতার ঋণ শোধ করতে চায়। এক্ষেত্রে কবি সামসুর রহমান তার দায়িত্ব পালন করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।
কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ১ঌ২ঌ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকা শহরের মাহুতটুলিতে অবস্থিত নানার কোঠাবাড়িতে। বাবা মোখলেসুর রাহমান চৌধুরীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন পুত্র রেখে মারা যান। তার মৃত্যুর পর তারই ছোটবোন আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। আমেনা বেগমের দশ সন্তানের মধ্যে শামসুর রাহমান জ্যেষ্ঠ। শামসুর রাহমানরা চার ভাই ও ছয় বোন।
শামসুর রাহমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পোগজ স্কুলে। ১ঌ৩৬ সালে এ স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ছোট বোন নেহারের মৃত্যুতে একটি কবিতা লেখেন তিনি। সাহিত্যচর্চার কোনো নির্দশন নেই এমন এক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন কবি শামসুর রাহমান। পরিবারের কারো সঙ্গীত, চিত্রকলা ও সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে পুরনো ঢাকার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ কাওয়ালি ও মেরাসিনের গানের সাথে পরিচয় হয়েছিল শৈশবে। পরিবারের লোকজন কোনো অনুষ্ঠান হলেই কাওয়ালির আয়োজন করতো। প্রসূতির ছটিঘরে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হওয়া উপলক্ষেও মেরাসিনের গানের আয়োজন করা হতো।
বাবার সাথে শৈশবে নরসিংদীর পাড়াতলী যাওয়ার সুবাদে গ্রাম, মানুষ, গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, মেঘনা নদী, বজরা নৌকা ইত্যাদির সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। বড়শিতে মাছ ধরার বিদ্যাও রপ্ত করেছিলেন তিনি। পাড়াতলী থেকেই প্রাণ ভরে নিয়েছিলেন পল্লী প্রকৃতির স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ও বৈচিত্র। পরিবারের কেউ গায়ক, চিত্রকর ও সাহিত্যিক না হলেও, শৈশবেই জলজ্যান্ত এক কবির দেখা পেয়েছিলেন তিনি। সেই কবি বাবার বন্ধু আব্দুল মজিদ সাহিত্যরত্ন।
শৈশবে বাবাকে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কৃষকপ্রজা পার্টির সাথে জড়িত থাকতে দেখেছেন। পার্টির হয়ে ফজলুল হকের অনুরোধে ১ঌ৩৭ সালে রায়পুরা ও পাড়াতলীর জনগণের প্রতি ভালোবাসার টানে নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন তার বাবা। মুসলীম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা মোহাম্মদ সেলিমের কাছে হেরে যান তিনি। বাবার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তার চেতনায়ও প্রবাহিত ছিল।
ম্যাট্রিকুলেশনে তার পাঠ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের কয়েকটি গল্প। ১ঌ৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এসময় অবসরে রবীন্দ্রনাথে গল্পগুচ্ছের বাকি গল্পগুলো পড়ে শেষ করেন। কিছুদিন পর তিনি সদস্য হন পুরনো ঢাকায় অবস্থিত ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন পাঠাগারে। এখানে বসে পড়ে ফেলেন বঙ্কিম ও শরৎ চন্দ্রের রচনা। তিনি গদ্য দিয়ে পাঠাভ্যাস শুরু করেছিলেন। মূলত কলেজ জীবনে তিনি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন। শুরু করেন একের পর এক কবিতা লেখা। এক্ষেত্রে শিল্পী হামিদুর রহমান তাকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তারই উৎসাহে শামসুর রাহমান নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সেকালের বিখ্যাত সাপ্তাহিক `সোনার বাংলা`য় কবিতা পাঠান। ১ঌ৪ঌ সালের ১ জানুয়ারি `সোনার বাংলা`য় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ‘তারপর দে ছুট’ ছাপা হয়। ১ঌ৪৭ সালে আইএ পাশ করার পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। স্নাতক সম্মান পড়া শেষ বছর পর্যন্ত চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত বাউণ্ডুলে জীবনের কারণে পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১ঌ৫৩ সালে তিনি পাস কোর্সে স্নাতক পাশ করেন। মাস্টার্স ভর্তি হয়ে প্রথম পর্ব কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু শেষপর্বের পরীক্ষা আর দেয়া হয়নি। ১ঌ৫৫ সালের ৮ জুলাই লেখাপড়া মাঝপথে অসমাপ্ত রেখেই আত্মীয়া জোহরাকে সহধর্মিনী করেন। দুজনই দুজনকে আগে থেকেই পছন্দ করতেন। পরবর্তীতে পারিবারিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঘটা করেই তাদের বিয়ে হয়। শামসুর রাহমান দম্পতির পাঁচ সন্তান। তারা হলেন সুমায়রা রাহমান (১ঌ৫৬), ফাইয়াজুর রাহমান (১ঌ৫৮), ফৌজিয়া রাহমান (১ঌ৫ঌ), ওয়াহিদুর রাহমান মতিন (১ঌ৬০-১ঌ৭ঌ) এবং সেবা রাহমান (১ঌ৬১)।
১ঌ৬০ সালে প্রকাশিত হয় কবি শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। ১ঌ৬৩ সালে কবির `রৌদ্র করোটিতে` কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ। ১ঌ৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেন। শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা `দৈনিক পাকিস্তানে` কর্মরত। পেশাকে তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন দৈনিক পাকিস্তানের হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন ও শামসুর রাহমান। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সকল ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান। আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন, তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। এছাড়া তখন এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা `বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ ও গ্রন্থ ‘নিজ বাসভূম’। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন `আসুন আমরা আজ’ ও ‘একজন জেলে’। ১ঌ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।
১ঌ৬ঌ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রহমান। লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১ঌ৮৭ সালে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে `দৈনিক বাংলা`র প্রধান সম্পাদকের পদে ইস্তফা দেন কবি। তিনি ১ঌ৮৭ সাল থেকে পরবর্তী চার বছরের প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’ দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’ তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ রচনা করেন। ১ঌঌ০ সালে স্ব স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর ১ঌঌ১ সালে রচনা করেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’।
কবি শামসুর রাহমান ১ঌ৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন মর্নিং নিউজের সহ-সম্পাদক হিসেবে। ১ঌ৫৮ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যুক্ত হন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকাকেন্দ্রে। পরে আবার ফিরে আসেন ঊর্ধ্বতন সহ-সম্পাদক হিসেবে মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। এখানে তিনি ১ঌ৬০-৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১ঌ৬৪ সালে দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করেন। ১ঌ৭৭ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এ সময় ‘একটি মোনাজাত’ কবিতা লেখার কারণে সরকারের রোষাণলে পড়েন তিনি। সাংবাদিকতার বাইরে তিনি প্রথম সম্পাদনা করেন লিটল ম্যাগাজিন `কবিকণ্ঠ`। ১ঌ৫৬ সালে তিনি ছিলেন এটির সম্পাদক মণ্ডলীর সম্পাদক। ১ঌ৮৭ সালে ক্ষণজীবী `অধুনা` সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ছিলেন তিনি। এরপর ‘সাপ্তাহিক মূলধারা’য় ১ঌ৮ঌ সালে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যুক্ত থেকে ১ঌঌ১ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১ঌঌ৬ সালে বাংলা একাডেমীর সভাপতি নিযুক্ত হন।
শামসুর রাহমান অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি গ্রহণযোগ্যতার এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যে, অনেক প্রতিষ্ঠানই তাকে সম্মানিত করতে পারলে নিজেরা সম্মানিত বোধ করে। ১ঌ৬৩ আদমজী পুরস্কার, ১ঌ৬ঌ বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১ঌ৭৩ জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার, ১ঌ৭৭ একুশে পদক, ১ঌ৮১ আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, ১ঌ৮১ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক ও পদাবলি পুরস্কার, ১ঌ৮২ মৌলানা ভাসানী পুরস্কার, ১ঌঌ১ স্বাধীনতা পুরস্কার, ১ঌঌ২ জাপানের মিত্সুসবিশি পদক (সাংবাদিকতায়), ১ঌঌ৪ ভারতের আনন্দ পুরস্কারসহ আরো অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। শামসুর রাহমানকে প্রথম কবি হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয় ১ঌ৭ঌ সালের ২৪ অক্টোবর। পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শামসুর রাহমান সংবর্ধনা পরিষদ বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট সবারপ্রিয়তম কবি, শামসুর রাহমান মারা যান।
.
লেখক: লুবনা ইয়াসমিন