নব্বই দশকের কথা। রঙ্গিন টিভি কলকাতার বাঙালির ঘরে তখন বিলাসিতা। সাদা-কালো টেলিভিশন সেটে দেখা যায় মাত্র দুটি চ্যানেল – ডিডি ওয়ান, ডিডি টু। সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তখন বোকাবাক্সের এক এবং একমাত্র ধারক-বাহক। তবে অধিকাংশ বাঙালি বাড়িতে টেলিভিশনের পাশাপাশি আরও একটি বিলাসিতা ছিল যা হলো টিভি সেটের পাশে চার কোনা বাক্সের বুস্টার সেট। ছাদে রাখা অ্যান্টেনার সঙ্গে যুক্ত সেই বুস্টার অন করলেই বাংলাদেশ এসে যেতো ঘরের ভিতর।
তখন সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময় বাংলাদেশের টেলি-নাটক দেখার জন্য পাড়ার কালার টিভিওয়ালা বাড়িগুলো রীতিমতো সিনেমা হলে রুপ নিতো। নব্বইয়ের শেষ দিক থেকে ভারতে শুরু হয় বেসরকারি চ্যানেলের যাত্রা। ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে যা রীতিমতো
টেলিভিশন চ্যানেলের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে এখন রাজত্ব চালাচ্ছে মধ্য এবং নিম্নবিত্তের ড্রয়িংরুমে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি-জীবনে টেলিসোপের জনপ্রিয়তা এখন এতটাই বেশি যে, পুজোয় সিরিয়ালের নায়িকার নামে বিক্রি হয় শাড়ি। তৈরি হয় বিয়ের থিম। বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এই প্রবল প্রতাপে সরকারি চ্যানেল দূরদর্শন জীবন থেকে যেমন হারিয়ে গেছে তেমনই হারিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের এক তরুণ লেখক বন্ধু কিছুদিন আগে ফোন করে খানিক গালিগালাজই করছিলেন — ‘পশ্চিমবঙ্গের বই ঢাকায় কলেজ স্ট্রিটের আগেই পৌঁছে যায়। অথচ তাদের বই আমরা ঢুকতে দিই না কলকাতার বাজারে।’ অভিযোগ অসত্য নয়। কথায় কথায় টেলিভিশন-বিরোধী ওই বন্ধু জানাল, অর্থের প্রয়োজনে ইদানীং টেলিভিশনে নাটকও লিখছেন তিনি। সঙ্গে যোগ করলো– ‘তোকে বলে কী হবে? তোরা তো বাংলাদেশের চ্যানেলও ভারতে ঢুকতে দিস না!’
বন্ধুর গলায় অভিমানের আর্দ্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, পালটা প্রশ্নে জর্জরিত করতে পারিনি এই বলে যে, ‘তোরাও তো শুনছি ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ করে দিচ্ছিস।’
ওঁর সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই মন খচ খচ করছিল এই ভেবে যে, কেন বুস্টারের পর বাংলাদেশের চ্যানেল এ দেশে আর দেখতে পাই না তেমন? এর পিছনে কি লাল ফাইলের কূটনীতির খেলা আছে? নব্বইয়ের একেবারে শেষ দিকে, অথবা ২০০০ সালের গোড়ায় কিছুদিন ‘চ্যানেল আই’ দেখা যেত, যত দূর মনে পড়ছে। তাও তো উধাও হয়ে গেছে সেট টপ বক্স থেকে! কিন্তু, অন্য বিদেশি চ্যানেল তো আছে! টাকা দিলেই আর সব চ্যানেলের মতো ডিডাব্লিউ, বিবিসি, চিনের চ্যানেল যদি দেখা যায়, বাংলাদেশের চ্যানেল নয় কেন?
প্রশ্নের তথ্যবহুল জবাব দিলেন কলকাতার ডাকসাইটের প্রযোজক হিমাংশু ধানুকা। একাধিক ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় অংশ নিয়েছেন তিনি। ধানুকার বক্তব্য, বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে দেখা যাবে না, এমন কোনও আইন বা নীতি নেই। যে কোনও বিদেশি চ্যানেল ভারতে দেখানোর ক্ষেত্রে আইন এক। যে চ্যানেল দেখানো হবে, তার পাঁচ কোটি টাকার নেট অ্যাসেট থাকতে হবে। এবং দুই, ডাউনলিঙ্কিংয়ের জন্য ভারতকে বছরে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে সেই চ্যানেলকে। গোটা প্রক্রিয়াটি হবে ইনফরমেশন এবং ব্রডকাস্টিং মন্ত্রকের মাধ্যমে। মাঝে মধ্যস্থতাকারী ভারতীয় সংস্থা থাকতে পারে।
এখানেই বিপত্তি। ধানুকার বক্তব্য, বাংলাদেশের চ্যানেলগুলি এই অর্থ খরচ করে ভারতে আসার ঝুঁকি নিচ্ছে না। এবং সে কারণেই বাংলাদেশের চ্যানেলও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত বাঙালির ড্রয়িংরুমে ঢুকতে পারছে না। কিন্তু ভারতের চ্যানেলগুলি বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে যাচ্ছে। ফলে সেখানে ভারতীয় চ্যানেলের রমরমা ব্যবসাও চলছে। বাংলাদেশের নতুন ব্যবস্থায় অবশ্য তা আর সম্ভব হবে না।
ধীরাজ শর্মা ভারতে বিদেশি টেলিভিশন নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সমন্বয়কারীর কাজ করেন। চিনের দুটি চ্যানেল তাঁর সংস্থার মাধ্যমে ভারতে দেখানো হয়। তাঁর বক্তব্য, বাংলাদেশের কোনও চ্যানেল তাঁর সংস্থার সঙ্গে কখনও যোগাযোগ করেনি। ভারতে কি তাহলে বাংলাদেশি টেলিভিশন কনটেন্টের বাজার নেই?
এ প্রশ্নের উত্তর মেলে নেট দুনিয়ায়। বাংলাদেশের নাটক দেখার প্রবণতা এখনও আছে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের বাঙালির মধ্যে। টেলিভিশনের বদলে ইউটিউবে তাঁরা এখন সেই সমস্ত নাটক দেখেন। ইন্টারনেটে বাংলাদেশের খবরও শোনেন ভারতের মানুষ। তবে এর বাইরে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান দেখার বড় একটা প্রবণতা নেই।
এক সময় বাংলাদেশের একটি প্রোডাকশন হাউসের জন্য কাজ করতেন এক বন্ধু। এখন ওড়িশায় জি বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, এই সময়ের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের গান জনপ্রিয়। কিন্তু অন্য কনটেন্টের চাহিদা তেমন নেই। তবে একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘চাহিদা জোগানের উপরেও নির্ভর করে। যেহেতু জোগানই নেই, তাই চাহিদা আছে কিনা, তা বলা কঠিন।’
বছরকয়েক আগে কলকাতার এক এডিটিং হাউসে আলাপ হয়েছিল বাংলাদেশের এক প্রসিদ্ধ সিনেমা পরিচালকের সঙ্গে। এডিট রুমে নিয়ে গিয়ে তিনি তাঁর সিনেমার প্রোমো দেখিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ পরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে যার মুক্তি ঘটবে। চমকে গিয়েছিলাম। অসাধারণ সিনেমার গল্প। সাতদিন বাদে ঢাকায় রিলিজ হয় সেই ছবি। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে উড়ে গিয়েছিলাম ঢাকায়। পরপর দু’দিন দু’টি হাউসফুল প্রেক্ষাগৃহে পরিচালকের পাশে বসে দেখেছিলাম সেই ছবি। এর ঠিক এক বছর পরে কলকাতায় এসে সেই পরিচালক জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় প্রোডাকশন হাউসকে ছবিটি বিক্রি করেছেন তিনি।
কত টাকায়? অস্বস্তির সুরে টাকার অঙ্ক জানিয়েছিলেন পরিচালক। ওই টাকায় পশ্চিমবঙ্গে একটি শর্টফিল্মও কেউ বিক্রি করতে রাজি হয় না। পরিচালক চেয়েছিলেন, নামমাত্র মূল্যে ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সামনে উপস্থিত করতে।
লাভ হল কি? নামমাত্র মূল্যে ছবিটি কিনল বটে ওই প্রোডাকশন হাউস। ভারতে ওই ছবির সত্ত্ব ঢুকিয়ে নিল নিজেদের পকেটে। কিন্তু প্রচার করল না। প্রচার করলে, আলবাৎ বলতে পারি, চাহিদা তৈরি হত।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের কনটেন্টের চাহিদা তৈরি হওয়ার জায়গা আছে বলেই মনে করি। কিন্তু তার জন্য আমাদেরও একটু সক্রিয় হতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সেই সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না বলেই মনে হয়। আর চাহিদা যদি থাকে, তাহলে কেউ প্রচার আটকাতে পারে না।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিবেদনই তুলে ধরা হয়েছে।)