জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে একটি বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান খুঁজে বের করারও তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল পরিণাম থেকে বাঁচাতে কমনওয়েলথ এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামকে (সিভিএফ) একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার (১ নভেম্বর) স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনের সাইডলাইনে ‘ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ বিষয়ে সিভিএফ-কমনওয়েলথ উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংগঠন সিভিএফ-এর সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বৈশ্বিক এবং আন্তঃসীমান্ত সমস্যা। কোনো দেশই এর ভয়াল পরিণাম থেকে সুরক্ষিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “ক্রমাগত জলবায়ু বিপর্যয় বাড়ছে। সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অপরিবর্তনীয় ক্ষতির শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বৈশ্বিক খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলছে।”
সম্প্রতি প্রকাশিত জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার কমিটির (আইপিসিসি) প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আইপিসিসি প্রতিবেদনটি পরিষ্কার সর্তকবার্তা দিয়েছে-আমাদের পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে জরুরি এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।”
এছাড়া আইপিসিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে মানবসভ্যতা চূড়ান্ত বিপদের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। আর এজন্য মানুষই পুরোপুরি দায়ী। আগামী দুই দশকের মধ্যেই পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল হিসেবে এই শতকের শেষে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার বৃদ্ধির জন্য ভয়ানক পরিণতির মুখে পড়বে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলগুলো।
জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ক্লাইমেট ভালনেরবল ফোরামের সদস্য ৪৮টি দেশ বিশ্বের মোট পরিমাণের মাত্র ৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করেছে।”
শেখ হাসিনা আরও‘ বলেন, “করোনা মহামারিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী, সাহসী এবং সংবেদনশীল কাজের জন্য কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয়ের তাৎপর্য প্রমাণ করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয়তাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করতে প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করা দরকার।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রায়ই বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের প্রথম শিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়।”
দুর্বলতা এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ নিয়েছি বলে জানান তিনি।
এছাড়া কম কার্বন নিঃসরণের পথ অনুসরণ করে ‘জলবায়ু দুর্বলতাগুলোকে’ ‘জলবায়ু সমৃদ্ধিতে’ রূপান্তর করতে বাংলাদেশ ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
সিভিএফের এক-তৃতীয়াংশ দেশ কমনওয়েলয়েরও সদস্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ এক সঙ্গে কাজ করতে পারে।”
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ
এ সময় সিভিএফ এবং কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম সুপারিশে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ এবং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান অর্জনে জ্ঞান, গবেষণা, সক্ষমতা তৈরি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন শেখ হাসিনা।
দ্বিতীয় সুপারিশে প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সবাইকে সম্মিলিত অবস্থান নিতে বলেন। এ ক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত অবস্থান জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তৃতীয় সুপারিশে জলবায়ু অভিবাসী ইস্যুতে কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে জলবায়ু অভিবাসীরা তাদের পৈত্রিক ভিটে-মাটি, ঐতিহ্যগত পেশা হারাচ্ছে। এই মানুষগুলোর পুনর্বাসনে বৈশ্বিক দায়িত্ব রয়েছে।
চতুর্থ সুপারিশে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সবার ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ প্রধান গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলোকে তাদের উচ্চাভিলাসী এবং অ্যাগ্রেসিভ এনডিসিএস ঘোষণা করাতে একটি চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে।
পঞ্চম সুপারিশে শেখ হাসিনা জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহনীয় খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে ক্লিন অ্যান্ড গ্রিন টেকনোলজি হস্তান্তর করার কথা বলেন।