ডাচ বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে প্রতিবছর ডাচ বাংলা কয়েক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করে থাকে। অসচ্ছল-মেধাবী শিক্ষার্থীদের ‘স্বপ্ন পূরণের সেতুবন্ধন’ ডাচ-বাংলা ব্যাংক তার শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে আসছে।
ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছতার সাথে এই কার্যক্রম পরিচালনা করায় ইতোমধ্যে সকল মহলের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিএসআরের অধীনের এই উপবৃত্তিটি। তবে করোনা প্রকোপ শুরুর পর থেকে বন্ধ রয়েছে তাদের এই কার্যক্রম। ফলে বিপাকে পড়েছেন বৃত্তির আওতায় থাকা অন্তত ২০ হাজার শিক্ষার্থী। সেই সাথে নানা মাধ্যমে সমালোচিত হচ্ছে ব্যাংকটির শিক্ষাবান্ধব এই কার্যক্রম।
ডাচ বাংলা ব্যাংক নিজেদের ফাউন্ডেশনের নামে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রমে ব্যয় করে থাকে। তবে গত প্রায় দুবছর যাবত বন্ধ রয়েছে। এতে ২০ হাজার শিক্ষার্থীর লেখা পড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
শিক্ষার্থীদের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই বৃত্তির টাকা পাচ্ছেন না তাদের অনেকে। সে হিসেবে প্রায় ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে তাদের শিক্ষাবৃত্তি। তবে প্রতিষ্ঠানের দাবি করোনাকালীন লকডাউনের সময় থেকেই বৃত্তি প্রদান বন্ধ রেখেছেন তারা।
তথ্যমতে, এসএসসি পরীক্ষায় মেধার সাক্ষর রাখা শিক্ষার্থীদের মাসিক ভিত্তিতে দুই হাজার টাকা করে ২৪ মাস বৃত্তি দিয়ে থাকে ডাচ বাংলা ব্যাংক। এছাড়া শিক্ষা উপকরণ কেনার জন্য আড়াই হাজার টাকা এবং ড্রেসের জন্য দেয় এক হাজার টাকা। আর অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বছরে এককালীন দেয়া হয় ছয় হাজার টাকা। এছাড়া প্রতিমাসে দেয়া হয় আড়াই হাজার টাকা। যা দিয়ে অসচ্ছল কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের পরবর্তী পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন। তবে দীর্ঘ সময় ধরে বৃত্তির এই অর্থ না পাওয়ায় আর্থিক সংকটে ভুগছেন তারা।
মধ্যে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক স্কলারশিপ সবার কাছে একটা পরিচিত মুখ। ব্যাংকটি প্রতি বছর প্রায় ১০২ কোটি টাকা অর্থ ব্যয় করে থাকে শিক্ষাবৃত্তি শাখায়। কিন্তু নিয়মানুযায়ী গত জানুয়ারি মাসে স্কলারশিপের জন্য ধারাবাহিকভাবে নবায়ন করেও সৃষ্ট চলমান করোনা পরিস্থিতির জন্য সবার বৃত্তি স্থগিত করে দেয় ব্যাংকটি।
এইচএসসি শিক্ষার্থীদের ২০১৯ ব্যাচের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টাকা দিলেও এইচএসসি ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ব্যাচের সবার টাকা স্থগিত করা হয়, একই সাথে এসএসসি -১৮, ১৯ ব্যাচের ও স্কলারশিপ মে থেকে স্থগিত রাখা হয়। এ কারণে বিপাকে পড়েছে বৃত্তিপ্রাপ্ত হাজারো শিক্ষার্থী। সংশ্লিষ্ট বৃত্তি শাখার হেল্পলাইনে যোগাযোগ করলে তারা জানায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রিয়া দাস (ন্যাশনালের শিক্ষার্থী) বলেন, ‘এখন বাসায় অবস্থান করলেও আমাদের মেসভাড়া প্রতি মাসে পরিশোধ করা লাগছে। করোনার কারণে টিউশন বন্ধ, সব চাপ তাই পরিবারের উপর পড়ছে, যেটা আমার পরিবারের বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই অবস্থায় ব্যাংকের কাছে একটাই অনুরোধ, আমাদের অবস্থা বিবেচনা করে বৃত্তির অর্থ দ্রুত প্রদান করেন।’
মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ (চবি) বলেন, ‘ভালোবেসে দুঃখ পাওয়ার মতো এমন চমৎকার অনুভূতি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই!মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। নেই কোনো টিউশন, নেই উপর্জনের অন্য কোনো উৎস। ফলে জীবন চালিয়ে যেতে নানা রকম বাঁধার সম্মুখীন। যদি ডাচ বাংলা ব্যাংক এই সময়ে আমাদের পাশে থাকতো, তাহলে এই রকম সংকটে পড়তে হতো না। আশা করি কর্তৃপক্ষ আমাদের দিকটা বিবেচনা করবেন।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’র আখি বলেন, ‘আমি নিজে টিউশন ও শিক্ষাবৃত্তি এই দুই মিলিয়ে পড়াশোনাটা কোনভাবে চালিয়ে নিতাম, মাঝে মাঝে পরিবারকেও সাহায্য করতে হতো সেই টাকায়। আমাদের এরকম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আশায় ছিলাম ডাচ্ বাংলা ব্যাংক অবশ্যই আমাদের পাশে থাকবে। কিন্তু তা নিয়ে বর্তমান সবাই আমরা অনিশ্চয়তা ও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি।’
কাদের মন্ডল (ঢাবি) বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা হলেও অনলাইনে ডেটা কিনে ক্লাস করা লাগছে, মেসে না থেকেও ভাড়া দিতে হচ্ছে, বছরের শুরুতে ধার করে বই ও কিনেছি, অভাব অনটনের সংসারে এখন মরার উপর খাঁড়ার ঘা মনে হচ্ছে।’
লাদেন রহমান (রাবি) বলেন, ‘আমার বাবা একজন রিকশাচালক, দিন এনে দিন খাই, এই মুহূর্তে মেসভাড়া প্রতি মাসে দিতে হচ্ছে, বই কেনা বাবদ পূর্বের ধারের টাকা বাকি, তাই আশাকরি ডাচ বাংলা আমাদের ব্যাপারটা বুঝবে এবং দ্রুতই টাকাগুলো দিয়ে দিবে।’
শাহ জাহান সরকার (জবি) বলেন, ‘আমাদের হল নাই, ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া করে বা মেসে থাকতে হয়, এখন না থেকেও ভাড়া দিতে হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ধার-দেনা করে চলেছি। আশাকরি ডাচ বাংলা আমাদের সমস্যাটা আমলে নিয়ে টাকাগুলো দিবে।’
আরেক শিক্ষার্থী নুরুল ইসলাম (রুয়েট) বলেন, ‘এসএসসি থেকে ডাচ্-বাংলা আমার পাশে আছে। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। বৃত্তির টাকা এবং টিউশনের টাকা দিয়ে আমি নিজে চলি এবং বাড়িতে টাকা পাঠাই। কিন্তু এই করোনা মহামারিতে টিউশন না থাকায় বৃত্তির টাকাটা বেশি প্রয়োজন। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও রুম ভাড়া, খাবার বা একাডেমিক খরচ তো দিতেই হবে।’
আবুল হাসান বলেন, ‘ডাচ বাংলার টাকাটা যে কতটা দরকারি তা আমাদের মতো স্টুডেন্ট ছাড়া বুঝবে না, খুব অসহায়ভাবে দিন কাটছে। তাই আশাকরি এই করোনা মহামারিতে ডাচ্ বাংলা আমাদের বৃত্তি কার্যক্রম সচল রাখবে।’
করোনাভাইরাস মহামারির সময় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যখন তাদের বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীর অনুদান হিসেবে অতিরিক্ত টাকা প্রদান করেছে, সেখানে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের এমন আচরণ, বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে হতাশা ও অভিমান তৈরি করছে।
ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন করোনার কারনে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের শিক্ষা বৃত্তি বন্ধ ছিল। এখন পরিস্থিতি উন্নত হচ্ছে এজন্য শিক্ষা বৃত্তি পুনরায় চালু করার কাজ চলছে। আমার আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের শিক্ষা বৃত্তি চাল করতে পারবো। শিক্ষা বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের দাবি নবায়নের টাকা যতদ্রুত সময়ের মধ্যে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হবে।