বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত কয়েক দশকে নানা খাতে উন্নতি লাভ করলেও দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি বর্তমানে চরম হতাশায় নিমজ্জিত। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তাদের এই হতাশাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকে জীবনের হিসাব আর মিলাতে পারছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে উচ্চবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসাভাড়া বাবদ খরচ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তরা এখন মহাবিপদে।
যদিও বাংলাদেশের রাজনীতির নানা উত্থান-পতনে তাদের নেতৃত্বই ছিল অগ্রগামী। দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতাসংগ্রামে মধ্যবিত্তদের সীমাহীন ত্যাগ রয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা রাজনীতি, নীতিনির্ধারক ও ক্ষমতার ভারকেন্দ্র হতে অনেকটা ছিটকে পড়েছে। ফলে স্বাধীনতার পঞ্চাশ দশকেও তাদের উন্নতি হয়নি।
করোনা মহামারির লকডাউন পরবর্তী সময়ের সংকটকালে প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হচ্ছে দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারদের। তারা ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে পারে না। অভাবের কথা মুখ ফুটে বলতেও পারে না। মধ্যবিত্তের অবস্থান মাঝখানে। তাই না পারে নীচে নামতে, না পারে ওপরে উঠতে।
মধ্যবিত্তের বাড়তি আয় নেই, অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বাসভাড়া লাগামহীন, ব্যাংক আমানতে সুদ কম, গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, ঘরে ঘরে বেকারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিতে জীবন এবং জীবিকায় এই শ্রেণির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনার দুরবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা যখন এই শ্রেণির মানুষের ব্রত, তখন তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবকিছুই লন্ডভন্ড। জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবন বাঁচাতে জীবিকা রক্ষা কঠিন হয়ে গেছে।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা কি করবেন, এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না। যার জন্য নির্ধারিত মূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য টিসিবির ট্রাকের সামনে কর্মজীবী মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। নিরুপায় হয়েই তারা টিসিবির পণ্য কেনেন কষ্ট করে। এসব পণ্য বাজারে কেনার সামর্থ তাদের নেই। করোনা মহামারির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেকের বেতন হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য উৎস থেকেও কমে গেছে আয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর জরিপে দেখা গেছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হরিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ৩২ দশমিক ১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭ দশমকি ২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯ দশমকি ৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।
এই জরিপে কিন্তু মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত স্পষ্ট। জানা যায়, লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরিতে যারা নতুন আসেন, তাদের বেশিরভাগই এই মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। দীর্ঘ দেড় সরকারি নিয়োগ বন্ধ থাকায় তাদের স্বপ্ন এতোদিন ধোঁয়াশায় ঢাকা পড়েছিল। এখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে।
কিন্তু সব পরীক্ষা রাজধানীতে হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের অনেকেই নানা পন্থায় অর্থ সংগ্রহ করে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় এতেও পরিবারগুলোকে বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংসারের খরচ কমিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য মরিয়া মানুষগুলো সবকিছুই মূল্যবৃদ্ধিতে হতোদ্যম। এ অবস্থায় সিপিডি জ্বালানির মূল্য আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করার মেকানিজমে বৈজ্ঞানিক কোনো মেথড মানা হয়নি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিত্তবানদের ওপর প্রভাব না পড়লেও মধ্যবিত্ত, দরিদ্র এবং যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, যারা করোনা আক্রান্ত অর্থনীতিতে নতুন করে রিকোভারির চেষ্টার মধ্যে রয়েছে, তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গেছে।
সূত্র জানায়, চাল, আটা, তেল, চিনি ও ডাল আগের মতোই বাড়তি দামে কেনাবেচা হচ্ছে। সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী। তেলের মূল্যবৃদ্ধির গরম বাজারে লাগায়- জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাধারণ মানুষের। তাদের আয় ও সঞ্চয়ে প্রভাব পড়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় বলতে এখন আর তেমন কিছুই নেই। দিন এনে দিন খেয়ে কাটছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের আরো চাপে ফেলেছে শীতকালীন সবজির বাড়তি দাম। উচ্চমূল্যে এসব সবজি কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষ অনেকটাই দিশেহারা।
এদিকে নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন লাগার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। ডিজেল ও সিএনজিচালিত বাসে ‘স্টিকার লাগানো’ বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত, মালিক সমিতির নানান হুঁশিয়ারি, বাসে ভাড়ার চার্ট লাগানো কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। বাস মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। বাসের ড্রাইভার, হেলপার, কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে যাত্রীদের ঝগড়া, মারামারি হচ্ছে নিত্যদিন। কিন্তু যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া বেশি নেওয়ার প্রবণতা কমছে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ (বিসিজি) ২০১৫ সালেই বাজার ও চাহিদার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামর্থ্য বাড়ছে। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে যুক্ত হচ্ছে। সচ্ছল বা উচ্চবিত্তের সংখ্যাও বাড়ছে সমানতালে।
ফলে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এফএমসিজি) জন্য বাংলাদেশ বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ে ১০ শতাংশ হারে মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে ৩ কোটি ৪০ লাখ হবে।
কোভিড সবকিছুই পাল্টে দিচ্ছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা নেমে এসেছিল ৪০ শতাংশে। এরপর ক্রমে দারিদ্র্যের হার কমেছে। যেমন, কোভিডের আগে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। মহামারিতে কত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, এর কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম জরিপ করে বলছে, ৪২ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র। অর্থাৎ, এক কোভিডেই বাংলাদেশ প্রায় ২০ বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশিমকি ৩১ শতাংশ। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এই ধারা চলতি বছর আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামে আগুন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এখন দাবানলে পরিণত হচ্ছে। বাসের ভাড়া বাড়ছে, লঞ্চের ভাড়া বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ছে।
দেশের নীতিনির্ধাক ও ক্ষমতার ভরকেন্দ্র পর্যায়ে অর্থনীতির মূল কাঠামোতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের নিয়ে গবেষণা করা হয় না। ফলে হুটহাট করে যে যেভাবে পারছে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর এ মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে কোনো সরকারের কাছে কোনো জবাবদিহিও করতে হয় না। ফলে অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধিতে সব থেকে বেশি বিপদে আছেন মধ্যবিত্ত মানুষেরা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এমনিতেই দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি। এরমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সার্বিক অর্থনীতিতে এর বহুমুখী প্রভাব পড়েছে। গণপরিবহন, কৃষি উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে। গত কয়েক মাসে আমরা খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী দেখছিলাম। এখন সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। একই সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবক্ষয় (বেশি টাকায় কম পণ্য) হবে। একদিকে কম আয়, অন্যদিকে ব্যয় বেশি হওয়ার ফলে জীবনযাত্রার ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়বে। আর এ চাপ সামাল দিতে গিয়ে অনেকেরই শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে হবে।