২০১৭ সালে প্রাথমিক স্কুল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলে দেশসেরা খেলোয়াড় সিহাব উদ্দিনের এখন কেউ খোঁজ নেয় না। টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পেলেও, অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে প্রতিভাবান এই ক্ষুদে ফুটবলার। দারিদ্রতার কষাঘাতে ফিকে হয়ে গেছে তার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। সংসারের হাল ধরতে বন্ধ হয়ে গেছে তার লেখাপড়া। কখনও ভ্যান চালিয়ে, আবার কখনও দিনমজুর হয়ে কাজ করে চলছে তার সংগ্রামী জীবন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সিহাবের শিক্ষক ও এলাকাবাসীর দাবি, সিহাবকে প্রশিক্ষিত করতে দরকার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার আলোকদিয়ার গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক কোরবান হোসেনের ছেলে সিহাব উদ্দিন (১৪)। তার মা শেবা খাতুন মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় সিহাব ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলায় দক্ষ হয়ে ওঠে। ছোট ভাই সিয়াম পড়ে শিশু শ্রেণিতে।
২০১৭ সালে তার নেতৃত্বে প্রাথমিক স্কুল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবলে সারাদেশের মধ্যে রানার্সআপ হয় পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে সিহাব। শুধু তাই নয়, এর আগে তার অধিনায়কত্বে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ওই স্কুল।
অথচ প্রতিভাবান এই ক্ষুদে ফুটবলারের খোঁজ নেয় না কেউ। অনাদর আর অবহেলায় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন আজ তার ফিকে হয়ে গেছে সিহাবের। দারিদ্রতার চাকায় পিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকাটাই তার কাছে দুঃসহ হয়ে উঠেছে। দুই ভাই ও বাবা-মাকে নিয়ে অভাবের সংসারের হাল ধরতে কখনও ভ্যান চালিয়ে, কখনো বা দিনমজুর হিসেবে তাকে কাজ করতে হয়। আলোকদিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বন্ধ হয়ে গেছে তার লেখাপড়া। এখন কীভাবে ফুটবলার হবে আর কীভাবেই বা বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই সিহাবের।
আলাপকালে সিহাব উদ্দিন জানায়, দেশের সেরা খেলোয়াড় নিবাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেয়া আমার জন্য গর্বের। কিন্তু তারপর থেকে আর কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। এখন আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় কখনো ভ্যান চালাই, আবার কখনও দিনমজুরি করি। লেখাপড়াও হচ্ছে না। এমন অবস্থায় কীভাবে আমার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে, তা ভেবে পাচ্ছি না।
সিহাব জানায়, আমি ভালো ফুটবলার হতে চাই। আমার গ্রাম, জেলা ও বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। যদি সরকার থেকে আমাকে সহযোগিতা করা হয়, তাহলে ফুটবল খেলে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবো।
সিহাবের ফুটবল খেলার প্রশিক্ষক ও বাফুফের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রেফারি রাজু আহমেদ জানান, ভালো ও দক্ষ ফুটবলার হওয়ার সব গুণই সিহাবের মধ্যে আছে। কিন্তু স্কুল ফুটবলে দেশসেরা খেলোয়াড় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিলেও আজ সে উপেক্ষিত। এর চেয়ে দুঃখের-হতাশার বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
তিনি জানান, সিহাবকে নিয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি করাতে গেলে সেখানকার প্রশিক্ষক কর্মকর্তারা তার পাঁচটি পরীক্ষা নেয়। যার চারটিতে প্রথম ও একটিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও তাকে সুযোগ দেয়া হয়নি।
সিহাবের মতো কৃতি ফুটবল খেলোয়ারকে যথাযথ মুল্যায়ন না করায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ তার শিক্ষকরা। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা ও আলোকদিয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইমাম হোসেন বলেন, সিহাব মেধাবী একটা ছেলে। সেরা খেলোয়াড় হয়েও আজ ভ্যান চালায়। এত অল্প বয়সে তাকে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তার লেখাপড়া-খেলা দুইটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারলে দেশের ফুটবল অঙ্গনে সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
সিহাবের বাবা কোরবান আলী জানান, সিহাব ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতে খুব ভালোবাসে। আমার তো বাড়িটুকু ছাড়া কোনো কিছু নাই। গরিব মানুষ, ভ্যান চালিয়ে দিন আনি, দিন খাই। সিহাবকে ফুটবল খেলোয়াড় বানানোর মতো সামর্থ্য আমার নাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, সিহাবকে সহযোগিতা দিয়ে যত্ন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিন। তাহলে দেশের জন্য সে সুমান বয়ে আনবে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পাবনা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল হক মানিক বলেন, দেশের আনাচে-কানাচে থাকা এসব প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের যত্ন করে তুলে আনতে পারছি না। আমাদের কাছে খবর আসলে আমরা তাদের প্রতি হয়তো একটু সহানুভূতি দেখাই, শুধু এ পর্যন্তই করা হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রচণ্ড অভাব। আমি আগামী অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে খেলাতে সিহাবকে নিয়ে আসবো। যদি সে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে, তাহলে পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সিহাবের মতো ক্ষুদে খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করে তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে একদিন তারাই হবে আগামী দিনের দেশের ফুটবলের কাণ্ডারি, এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।