নরসিংদীর মেঘনার তীরে শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বাউল মেলা। মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসা এই মেলায় অংশ নিতে দেশ-বিদেশের শতাধিক বাউল এরই মধ্যে নদীতীরে জমায়েত হয়েছেন।
মেলা ঘিরে মুখরোচক খাবার ও বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে প্রস্তুত দোকানিরাও। করোনার কারণে এবার সাত দিনের পরিবর্তে তিন দিন চলবে মেলা।
মেঘনার তীরে আগে এ মেলা চলত মাসব্যাপী। নদী দিয়ে যাওয়ার সময় সওদাগররা পালতোলা নৌকা তীরে ভিড়িয়ে এ ঘাটে পুণ্যস্নান করে ঘি-প্রদীপ জ্বেলে মনোবাসনা পূরণ করতে আসতেন। ফেরার পথে কিনে নিতেন খাট-পালংসহ নানা গৃহস্থালি জিনিস।
মহাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে বুধবার সকালে শুরু হয় মেলার আনুষ্ঠানিকতা। যদিও প্রথম দিনে মেলায় খুব একটা ভিড় দেখা যায়নি।
এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ বাঙালি চিরাচরিত সব খাবার। আমিত্তি, জিলাপি, সন্দেশ, বারোমিঠাই, দই, মুড়ালি, গুড়ের তৈরি মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, তিলের মোয়া, তিলের সন্দেশ, খাস্তা, কদমা, নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, খাজা, গজা, নিমকি, মনাক্কা, গাজরের হালুয়া, পিঠাসহ রকমারি খাবারের স্বাদ এককথায় অতুলনীয়।
এসব খাওয়ার ফাঁকে শিশুদের জন্য কিনে নিতে পারবেন বাহারি খেলনা। আছে নাগরদোলাসহ নানা রাইডের ব্যবস্থা। গৃহবধূদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মাটি ও বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি জিনিসের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী পোশাকের সমাহারও রয়েছে এখানে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আনুমানিক ৫০০ বছর আগে এই জেলায় বাস করতেন এক বাউল ঠাকুর। তার বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। তার স্মরণেই মূলত এই মেলা হয়ে আসছে প্রতি বছর।
শহরের কাউরিয়া পাড়া এলাকায় নরসিংদীর নতুন লঞ্চ টার্মিনালের পাশে বাউলের আখড়া। এখানেই বাউল ঠাকুরের অন্তর্ধান হয়েছিল।
আখড়ায় জগন্নাথের একটি মন্দির আছে। সেখানে জগন্নাথ ও মহাবিষ্ণুর প্রতিমার পাশাপাশি মা গঙ্গার (৩৩ কোটি দেবতার) ঘট, নাগ দেবতার বিগ্রহ ও শিবলিঙ্গ আছে।
প্রচলিত আছে, বাউল ঠাকুর নিজে এসব স্থাপন করে গেছেন। মন্দিরের পাশেই বাউল ঠাকুর ও মাতাজির সমাধি মন্দির। মাঝখানে উপাসনার জন্য রয়েছে আরেকটি মন্দির।
মেঘনার তীরঘেঁষা ওই বাউল সাধকের আখড়ায় কে বা কারা ঠিক কবে থেকে এই মেলার শুরুটা করেছিল, তাও জানা যায়নি।
২০০ বছর আগে যখন ব্রিটিশরাজের শাসন উপমহাদেশে, তখন থেকে এ পর্যন্ত মেলায় আয়োজন করে আসছে নদী রাম নামে এক বাউল ও তার বংশধররা। একসময় নদী রামের নাতি মনীন্দ্র চন্দ্র বাউল এর দায়িত্বে ছিলেন। মৃত্যুর পর তার পাঁচ ছেলে সাধন চন্দ্র বাউল, মৃদুল বাউল মিন্টু, শীর্ষেন্দু বাউল পিন্টু, মলয় বাউল রিন্টু ও প্রাণেশ কুমার ঝন্টু বাউল এই মেলার আয়োজন করে আসছেন।
আখড়ার সেবায়েত তত্ত্বাবধায়ক প্রাণেশ কুমার ঝন্টু বাউল সম্প্রতি মারা যান। এ বছর তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় আছেন তার ভাই মৃদুল বাউল মিন্টু।
মৃদুল বাউল বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সব ধর্মকে মানবতার ঊর্ধ্বে তুলে আনার জন্যই বাউল ঠাকুরের আর্বিভাব হয়েছিল। তাই বাউল মেলায় বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ অংশ নেয়। মহাযজ্ঞে জগতের কল্যাণের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের পূজা হবে। তবে করোনার কারণে এ বছর মেলা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
‘মরমি সাধকদের কাছে সাধনাই মূল ধর্ম। আত্মশুদ্ধি ও মুক্তির জন্য এ মেলায় আসেন তারা। তুলে ধরেন মানব প্রেমের গান। যোগ দেন পুণ্যস্নান, মহাযজ্ঞ ও পূজা অর্চনায়। অনেক পুণ্যার্থীও এসব আয়োজনে যোগ দেন।’
কুষ্টিয়া থেকে আসা রবীন্দ্র বাউল নামে একজন বলেন, ‘সারা বছর এই উৎসবের অপেক্ষায় থাকি। বাউল ঠাকুরের এই আঙিনায় আসলে সব ভক্তের সঙ্গে দেখা হয়। ধর্মীয় আলোচনা ও গান হয়। মনে প্রশান্তি আসে।’
আখড়া সূত্রে জানা যায়, আগত বাউলরা সংগীত পরিবেশন করবেন। তবে সেই সংগীত প্রথাগত বাউল সংগীত নয়, মানবতার গান। এই গান কোনো পুঁথিতে লিপিবদ্ধ নেই। বছরের পর বছর ধরে গুরুর কাছ থেকে আরাধনা করে শিষ্যরা এই গান আয়ত্তের ক্ষমতা অর্জন করেন।