পৃথিবী সূর্যের চারদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। আবার নিজ অক্ষেও ঘোরে, তাই বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ কখনো সূর্যের কাছে চলে যায়, আবার কখনো উত্তর গোলার্ধ। যখন যে অংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে তখন সেই অংশ খাড়াভাবে বেশিক্ষণ ধরে সূর্যের আলো ও তাপ পায়। আর তখন সেই অংশে বেশি গরম পড়ে। এ সময় থাকে গ্রীষ্মকাল।
একটা অংশ সূর্যের কাছে থাকা মানে তার উল্টো দিকের অংশটা থাকবে সূর্য থেকে দূরে। আর দূরে থাকলে সেই অংশটা কম আলো ও তাপ পাবে। তখন সেই অংশে থাকে শীতকাল। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক—বাংলাদেশে যখন গ্রীষ্মকাল, অস্ট্রেলিয়ায় তখন শীতকাল। আবার ওদের যখন গ্রীষ্ম, তখন আমাদের শীত। কারণ অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ আর বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধের দেশ।
কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করে বলে—হে রব, আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলেছে। মহান আল্লাহ তখন তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি দেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে, আরেকটি গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাকো। (বুখারি: ৩২৬০)
হাদিসের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরামদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।
১) প্রকৃত অর্থও হাদিসের অনুরূপ। ইমাম নববীও এই মতটি সমর্থন করেছেন।
২) কিছু ‘আলেম বলেন- হাদিসের প্রকৃত অর্থ নয়, বরং রূপক অর্থ নিতে হবে। এই মতের স্কলাররা বলেন, জাহান্নাম ও সূর্যের মধ্যে সূক্ষ্ম সংযোগ ও সম্পর্ক সৃষ্টি করে রেখেছেন আল্লাহ। সে অনুযায়ী, জাহান্নাম থেকেই উত্তাপ গ্রহণ করে সূর্য, আর সূর্য তাপ বিকিরণে যন্ত্রের মতো কাজ করে। তাই সূর্যের দূরত্ব অনুপাতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গ্রীষ্মকাল বা শীতকাল হয়।
৩) কিছু স্কলার বলেন, জাহান্নামের নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকাল বা শীতকাল নয়, বরং নিঃশ্বাস গ্রীষ্ম বা শীতকালে ঘটে। এ বিষয়ে ইমাম ইবনু আব্দিল বার(র.) তার তামহিদ গ্রন্থে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন—জাহান্নামের নিঃশ্বাস শীতকালে ঘটে; নিঃশ্বাস শীতকাল নয়। জাহান্নামের নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকালে ঘটে; নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকাল নয়। (আত তামহিদ: ৮/৫)
৪) কিছু স্কলার বলেছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুটোই সঠিক। তাদের মতে, শীত-গ্রীষ্মের তীব্রতার জন্য প্রত্যক্ষ কারণ হলো পৃথিবীর উপর সূর্যের তীর্যক বা খাড়াভাবে আলো দেওয়া। আর পরোক্ষ কারণ হলো জাহান্নামের নিঃশ্বাস। রাসুল (স.) এখানে পরোক্ষ কারণ উল্লেখ করেছেন। আর প্রত্যক্ষ কারণকে উল্লেখ করেননি অপ্রআসঙ্গিক হওয়ায়। আর সেটা তো মানুষ জ্ঞানবুদ্ধি দ্বারাই বুঝতে সক্ষম। সুতরাং এটা সুনিশ্চিত যে, পরোক্ষ কারণের উল্লেখ প্রত্যক্ষ কারণের অনুপস্থিতিকে আবশ্যক করে না। তাই শীত-গ্রীষ্মকালের তীব্রতার জন্য জাহান্নামের নিঃশ্বাস সূর্যের আলোর তারতম্যের কারণকে বাতিল করে না।
গরমের তীব্রতা জাহান্নামের আগুণকে স্মরণ করিয়ে
আরবের মরু এলাকায় উত্তপ্ত বালু ও মরুঝড়ের কারণে সেখানে ভীষণ গরম দেখা দিত। তাই রাসুলুল্লাহ (স.) জোহরের সালাত কিছুটা বিলম্বে আদায় করতেন। এ জন্য গরম বেশি পড়লে জোহরের নামাজ দেরিতে পড়া সুন্নত। আবু জার (রা.) বলেন, এক সফরে আমরা আল্লাহর রাসুল (স.)-এর সঙ্গে ছিলাম। একসময় মুয়াজ্জিন জোহরের আজান দিতে চেয়েছিল। তখন নবী (স.) বলেন, গরম কমতে দাও। কিছুক্ষণ পর আবার মুয়াজ্জিন আজান দিতে চাইলে নবী (স.) (পুনরায়) বলেন, গরম কমতে দাও। এভাবে তিনি (সালাত আদায়ে) এত বিলম্ব করলেন যে আমরা টিলাগুলোর ছায়া দেখতে পেলাম। অতঃপর নবী (স.) বলেন, গরমের প্রচণ্ডতা জাহান্নামের উত্তাপ হতে। কাজেই গরম প্রচণ্ড হলে উত্তাপ কমার পর সালাত আদায় করো। (বুখারি: ৫৩৯)।
সুতরাং গরমের তীব্রতা জাহান্নামের তীব্রতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজেই তীব্র গরমে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন ও হাদিসের ওপর সুদৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রাখার এবং সুন্নাহ অনুযায়ী দীনের সকল বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।