একাত্তরের যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল লক্ষ-কোটি প্রাণে, সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ মঙ্গলবার।
জাতির মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্নে ধারাবাহিক আন্দোলনের একপর্যায়ে ৫২ বছর আগের এই দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে যে ভাষণ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তা আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। তৎকালীন রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস ১৮ মিনিটে তুলে ধরে একাত্তরের সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়- ‘তারপর থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বজ্রকণ্ঠের হুংকার শুনে আজও মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে। একটি তর্জনীর নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি। সেই তর্জনী দেখেই অচল হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, যেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাঙালির মুক্তির সনদ রচনা করে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ভাষণকে ‘বজ্রকণ্ঠে রচিত ১৮ মিনিটের এক মহাকাব্য’ বলে বর্ণনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৭০-এর নির্বাচন ও তার পূর্ববর্তী সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসকে ধারণ করে জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ।
সত্তরের নির্বাচনে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে।
স্পষ্ট বিজয়ের পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথা বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিল না পাকিস্তানের দখলদাররা। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে একাধিক বৈঠকে। আর এ কারণেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যান, তখন তার বক্তব্য কী হবে তা নিয়ে ছিল অনেক ধোঁয়াশা। ৭ মার্চে জাতির পিতার বক্তব্যে ছিল দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলমান মানুষের বঞ্চনা, আন্দোলন, রক্তদানের কথা।
লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিন প্রচণ্ড জ্বর ছিল, বঙ্গমাতা (তার স্ত্রী) তাকে বললেন একটু রেস্ট নিয়ে যাও। তার কন্যা শেখ হাসিনা তখন তার মাথায় মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই রেসকোর্স ময়দানে সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের উদ্দেশে বের হলেন। তার নিজস্ব কোনো গাড়ি ছিল না। হাজি মোরশেদ গাড়ি চালাচ্ছিলেন আর সে গাড়িতে বসে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মোরশেদ বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এত জ্বর নিয়ে আপনি কী বলবেন? উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আল্লাহ যা বলায় তাই বলব। আমি টিএসসির দেয়ালে বসে ভাষণ শুনছি। আমি জানতাম এই ভাষণ ইতিহাস গড়বে, তাই গভীর মনোযোগ ছিল ভাষণের ওপর। ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে ১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ডে বক্তব্য শেষ করলেন।’
বাংলাদেশের ইতিহাস, বঞ্চনা, চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ, হতাশা এবং নতুন দেশ গড়ার আশা, সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে। ২০১৭ সালে ইউনেসকো এই ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন। মহান এ নেতার সে স্বপ্ন পূরণে আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’
দিবসটি উপলক্ষে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “ইউনেসকো মনে করে এ ভাষণটির মাধ্যমে জাতির পিতা প্রকারান্তরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি আজ বাঙালি জাতির জন্য এক বিরল সম্মান ও গৌরবের স্মারক। আমাদের হাইকোর্টের রায়ের ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আমি বিশ্বাস করি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।”
ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণ করে প্রতিবছর নানা আয়োজন থাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি পালন করে। ২০১৫ সাল থেকে এই দিনটিকে স্মরণ করে আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) জয় বাংলা কনসার্টের আয়োজন করেছে। পবিত্র শবে বরাতের কারণে এবারের আয়োজনটি থাকছে ৮ মার্চ।
৭ মার্চ ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনসহ আওয়ামী লীগের সব কার্যালয়ে সকালে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। দলীয় নেতা-কর্মীরা সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবে। বিকাল ৩টায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা সভা করবে ক্ষমতাসীন দলটি। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।