আমাদের যে স্বাধীনতা অর্জন সেটি কোনো কিছুর সঙ্গেই বিনিময়যোগ্য নয়। একটি জাতি যখন স্বাধীনতা পায় তার আর কিছু পাওয়ার অপূর্ণতা থাকে না। আমরা মনে করি, আমরা সব কিছুই পেয়েছি। তারপরও বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার সুফল সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, বাংলাদেশকে সাম্যের বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে হবে। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব। বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই আমরা অবিরাম চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে দীর্ঘ একটা সময় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার আদর্শকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তার দর্শন এ দেশ থেকে তারা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। সে কারণে এর মূল যে অর্জন স্বাধীনতা সেটি আমরা পেয়েছি এবং অক্ষুণ্ন রেখেছি। বায়ান্ন বছর ধরে স্বাধীন জাতি হিসেবে বসবাস করছি। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা অবিরাম চেষ্টা করে চলেছেন স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে। আমরা দেখেছি, তিনি মুজিববর্ষে ঘোষণা দিয়েছেন, দেশের একটি পরিবারও গৃহহীন থাকবে না। সে লক্ষ্যেই তিনি দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। অতি সম্প্রতিও তিনি বেশ কয়েকটি জায়গায় গৃহহীন মানুষের মধ্যে ঘর হস্তান্তর করেছেন।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে যদি পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে বহু অগ্রগতি, উন্নতিসাধন করেছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য যে মানুষের কথা বলেছিলেন সেই মানুষ তৈরি করতে এখনো আমরা সফল হইনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে যে সোনার মানুষ গড়ে তোলা, এটি আমাদের এখন একমাত্র আরাধ্য বলে আমি মনে করি। এটি এখন আমাদের প্রথম কাজ বলে আমি মনে করি।
অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক মুক্তি অর্থহীন হয়ে যাবে যদি না আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে না পারি। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার সম্প্রসারণ সব ক্ষেত্রেই কাজ করে চলেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বহু বাধাবিপত্তি আমাদের রয়েছে। কারণ আজকের পৃথিবী একটি বিশ্বপল্লিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে কোনো দেশই অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রতিটি দেশ পারস্পরিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। আমরা উৎপাদন করছি কিন্তু সেই পণ্য যদি রপ্তানি করতে না পারি বা আমাদের আমদানি যদি কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে ধরনের একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন এখন সারা পৃথিবী।
একবিংশ শতাব্দীকে আমরা মনে করেছিলাম সৌভাগ্য হিসেবে দেখব। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য একবিংশ শতাব্দীতে এসে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখতে হচ্ছে। পৃথিবীর এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা দেখতে পাচ্ছি। এগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনে বাধার সৃষ্টি করছে। তবে আমরা বাঙালিরা আশাবাদী মানুষ। যে জাতি ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছে সেই জাতি কখনো পিছিয়ে থাকবে না, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটি আমিও বিশ্বাস করি। অতএব বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে যে সাময়িক অর্থনৈতিক বাধাবিপত্তি চলছে সেগুলো কাটিয়ে উঠে অচিরেই আমরা সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলতেন, সে রকম বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে আমার চাওয়া একটাই- সেটা হলো বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হিসেবে যেটা চাইতেন সেটাই, স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি সেটা গড়ে তুলেছি। আমি সোনার বাংলা গড়তে চাই, সে কারণে আমি সোনার মানুষ দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধুর মতোই আমিও চাই বাংলাদেশের মানুষ সোনার মানুষে রূপান্তরিত হোক। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে যারা আগামী দিনে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে তারা যেন সত্যিকার অর্থে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ সৎ সুনাগরিক এবং একইসঙ্গে উদার মন-মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ধারণ করা মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। এমন মানুষ আমি সমাজে দেখতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই।
📝 আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক-
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়