দীর্ঘ সাধনা এবং ৯ মাস সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসল এ স্বাধীন বাংলাদেশ। নরসিংদী জেলায় ৬টি উপজেলার মাঝে ২৪ ইউনিয়ন ঘঠিত বৃহৎ উপজেলা রায়পুরা মুক্ত দিবস আজ ১০ ডিসেম্বের। এ দিনটিকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ বিশেষ অবদান, সাহসিকতাপূর্ণ বীরত্ব ও জীবন ত্যাগের মুহূর্ত স্মরণ করেন স্থানীয় মুত্তিযোদ্ধারা। এর মাঝে রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামে স্মৃতি বিজরিত চিহ্ন ৭১’র যুদ্ধজয় ও মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা হিসেবে নির্মিত বিজয়স্তম্ভটি আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় স্থানীয়রা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনের পাশ দিয়ে নরসিংদী-রায়পুরা সড়কের পাশে গ্রামের মেঠো পথে প্রবেশ মুখে ২০১১ সালে নির্মিত হয়েছে যুদ্ধের ব্যবহৃত বুলেট এর সদৃশ বিজয়স্তম্ভ। এটি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলামের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে উপজেলার সব মুক্তিযোদ্ধার সার্বিক সহযোগিতায় নির্মিত হয় বলে জানান স্থানীয়রা। কিন্তু এর পাশ দিয়ে সড়ক প্রশস্তকরণের কারণে ভেঙে ফেলতে হবে এ খবর পেয়ে হতাশ মুক্তিযোদ্ধারা।
বিজয়স্তম্ভ বিষয়ে কথা হয় গ্রামের লোকজনদের সঙ্গে। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী হোসেন বলেন, এই স্মৃতি বিজরিত চিহ্নটির স্থান থেকে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। এর পাশে একটি ব্রিজ ছিলো তা আমরা ভেঙে দিয়েছি। ওই পাশে একটি ব্রিজ ছিলো তাও ভেঙে দেই, এরপর আমরা প্রথমে রেলে আঘাত করি। এছাড়া গোলাগুলিসহ ব্যাপক যুদ্ধ হয়েছে এই স্থানে। এভাবে প্রতিহত করে পাকহানাদার ঢুকতে দেননি রায়পুরায়। স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর এখানে একটি বুলেট চত্বর নির্মিত হয়। কিন্তু রাস্তা প্রশস্তকরণের ফলে তা ভেঙে ফেলতে হবে। এটা দুঃখজনক। আমরা বাধা দেওয়ার পর, সংশ্লিষ্টরা বলে পরে দেখবেন বিষয়টি। আমাদের দাবি এটা একেবারে ধ্বংস না করে রাস্থা থেকে সড়িয়ে একটু পেছনের স্মৃতি ধরে রাখা হোক।
উল্লেখ্য- জাতীয় বীর সৈনিকদের ৪টি বিভিন্ন শ্রেণিতে খেতাবে ভূষিত করা হয়। নরসিংদী জেলার বীর কৃতি সন্তানরা বিভিন্ন শ্রেণিতে ৯টি রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। এরমধ্যে রায়পুরা উপজেলাতেই ৫টি। এরমধ্যে ১টি বীরশ্রেষ্ঠ (মরনোত্তার), ১টি বীর উত্তম, ২টি বীর বিক্রম ও ১টি বীর প্রতীক। আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে রায়পুরার স্মৃতি বিজরিত চিহ্নগুলো।
রায়পুরার ইতিহাস:
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডার বীর উত্তম ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এই দিনে হানাদার পাকিস্তানিদের কবল থেকে রায়পুরাকে মুক্ত করেন। স্বাধীনতার পর থেকে এদিন নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে রায়পুরা মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৭১ সালে ৭ এপ্রিল রায়পুরায় সংগঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় প্রশিক্ষণ। ১৩ এপ্রিল বেলাবোর বড়িবাড়ী এলাকায় পাক সেনাদের বিরুদ্ধে আট ঘণ্টাব্যাপী মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। ১৪ এপ্রিল রায়পুরা থানা আক্রমণ হয়। এতে পরে ১৮ মে পাকবাহিনী রায়পুরায় প্রবেশ করে। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম ও স্থবির হয়ে পড়ে যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা।
এরপর ১৮ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ের মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি ও বাঙ্গালীনগরে অবস্থিত ৫৫নং রেল সেতুটি ভেঙে দিয়ে দুই ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয় পাকহানাদের সঙ্গে। এতে ছয়জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন। এছাড়া ৩৩ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন- লতিফ কমান্ডার, কমান্ডার জয়ধর আলী, কাজী হারুন, প্রয়াত ইদ্রিস হালদার প্রমুখ।
৭ নভেম্বর পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ রণাঙ্গনে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে শহীদ হন চট্টগ্রাম রাউজানের সুবেদার বশর, রায়পুরা মরজাল গ্রামের সার্জেন্ট আ. বারি, খাকচক গ্রামের এয়ারফোর্সের নুরুল হক, রাজনগর গ্রামের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সোহরাব। এছাড়া, কাজী হারুন-অর-রশিদ, রাজনগর গ্রামের সুবেদার ইপিআর জয়দর আলী ভূঁইয়া ও ইদ্রিস হাওলাদারের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। অবশেষে ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় রায়পুরা।