নিউজ ডেস্ক,নরসিংদী প্রতিদিন,বৃহস্পতিবার,০৫ এপ্রিল ২০১৮: দেশে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সরকারি এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এ হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে শুধু অর্থের জন্য সিজার করছেন চিকিৎসকরা। ভুক্তভোগী অনেকে অভিযোগ করেছেন, চিকিৎসক সন্তানের ক্ষতির ভয় দেখিয়ে সিজার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর চিকিৎসকরা বলছেন, প্রসূতি ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত ইচ্ছায় সিজার করানো হয়। অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল এমনকি জাতীয় সংসদেও। এদিকে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, অপ্রয়োজনে সিজার করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে নরমাল ডেলিভারি ৬২.১ শতাংশ। সিজারিয়ান সেকশন ৩৫.৫ শতাংশ এবং অন্যান্যভাবে ২.৫ শতাংশ। এখন সিজারিয়ান সেকশনের হার দিন দিন বাড়ছে। ওই জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে গত তিন বছরে ২৩ শতাংশ ডেলিভারি হয়েছে সিজারের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ৩৭ শতাংশ ডেলিভারি হয়ে থাকে হাসপাতালগুলোতে। যার ২২ শতাংশ হয়ে থাকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।
বিডিএইচএস আরও জানায়, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি।
জানা গেছে, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশির ভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণির চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলেন। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেন। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি।
তবে চিকিসৎকদের ভাষ্য, বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েরা নরমাল ডেলিভারি করাতে ইচ্ছুক না। প্রসব যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পেতেই সিজারিয়ানে আগ্রহী হন নারীরা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সিজার বিষয়টা মেয়েদের কাছে ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে সচ্ছল পরিবারে ৫০ শতাংশ ডেলিভারি হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে। অন্যদিকে ২৩ শতাংশ শিশু জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান সেকশনে।
হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য: সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক প্রসবের খরচ সর্বোচ্চ তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা এবং অস্ত্রোপচারে খরচ সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এর বাইরে কেবিন ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। সরকারি জেলা হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের সময় রোগীর পক্ষকে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার ওষুধ কিনলেই চলে, আর অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কিনতে হয় কমপক্ষে তিন হাজার টাকার ওষুধ।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন সর্বশেষ নতুন বিশ্লেষণে বলেছে, গত বছর এমন অস্ত্রোপচারের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৮৭২। বছরে সিজারিয়ানে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। এছাড়া অস্ত্রোপচারে রোগীকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ করতে হয়।
গত বছরের ২ মার্চ জাতীয় সংসদে লিখিত প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, সরকারি হাসপাতালে প্রসবসেবা বাড়ানোর মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের হার কমানোর লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়া গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন,
‘সিজার করার প্রয়োজন যেখানে হবে না সেখানে যেন সিজার না করা হয় সেজন্য আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটা ফর্ম তৈরি করেছি। কোনো হাসপাতাল সিজার করলে তাদের বাধ্যতামূলক এ ফরম পূরণ করে আমাদের জানাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তারা যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক কি না আমরা যাচাই করব। যারা প্রয়োজন না হওয়া সত্ত্বেও সিজার করবে তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী ইসলাম বলেন, সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু প্রসবের প্রবণতা শিক্ষিত নারীদের মধ্যে বেশি। ঢামেক হাসপাতালে বছরে ৫০ শতাংশই হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। এটা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
সূত্র: খোলা কাগজ