চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে বেচাকেনা কমেছে নরসিংদীর গ্রে কাপড়ের বাজারে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার মাধবদীতে রয়েছে কয়েক শ গ্রে কাপড় উৎপাদনের কারখানা।
এখানে উৎপাদিত কাপড় দেশের কাপড়ের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। এ জেলার ছয়টি উপজেলায় কাপড় উৎপাদন করা হয়। এখানে প্রায় দুই হাজার টেক্সটাইল বা পাওয়ার লুম মিল-কারখানা রয়েছে।
প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার ও শুক্রবার মাধবদী বাজারে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন জাতের গ্রে কাপড়। তার মধ্যে রয়েছে পপলিন, ভয়েল, ভিসকস, অরগেন্ডি, লিনেন, মার্কিন ও টিস্যু কাপড়। অনেক কারখানা থেকে উৎপাদিত সাদা গ্রে কাপড় রঙ ও প্রসেসিং করে সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করেন।
এ ছাড়া সাদা গ্রে কাপড়গুলো রঙ ও ছাপা প্রিন্ট করে বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার নরসিংদীর বাবুরহাটে বিক্রি করা হয়।
মাধবদী বাজারের ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, প্রতি বছর শীতের শুরুতে এখানকার কাপড়ের ভালো বেচাকেনা হয়। কিন্তু এবারে বাজারে মন্দা চলছে। কাপড় উৎপাদন করে লোকসান দিতে হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ ছাড়া অনেকের কারখানায় শুধু এক সিপিটি মেশিন চলছে।
মন্দার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘করোনা সংকট কাটিয়ে না উঠতেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট চলছে। ফলে দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এতে ক্রেতারা কাপড় কম কিনছেন। এখন নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অবরোধ ও হরতালে পড়েছে দেশ। অবরোধ ও হরতালের প্রভাবে খুচরা বাজারে কাপড় বিক্রি কম হওয়ার ফলে উৎপাদিত গ্রে কাপড়ের বাজারে মন্দা যাচ্ছে।’
শফিকুল ইসলাম মিন্টু নামে মহাজন বলেন, ‘করোনার আগে এক গজ ভয়েল কাপড় বুনতে খরচ হতো ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। তা পাইকারি বাজারে বিক্রি করে কিছুটা লাভের মুখ দেখেছি। দিন দিন ব্যবসা নিয়ে নানা সংকটে পড়ে যাচ্ছি। আজ এক গজ গ্রে কাপড় বিক্রি করলে লোকসান দিতে হচ্ছে। সাদা কাপড় রং ও প্রসেসিং করে ঢাকার ইসলামপুর, গাউছিয়া মার্কেট, মাধবদীর বাবুরহাটে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা মুশকিল হয়ে গেছে।’
মাধবদীতে ম্যানচেস্টার চত্বরের পাশে পাইকারি কাপড় বিক্রেতা মো. কাউছার আহমেদ বলেন, ‘সপ্তাহজুড়ে এক রঙের লিনেন কাপড় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করা হয়। যা খুচরা বাজারে ৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বাজারের এমন মন্দা সময় আগে পার করেনি। প্রায় ৬০ লাখ টাকার মতো বাকি পড়ে গেছে। ব্যবসায়িক পার্টনারদের বেচাকেনা না থাকায় তারা আমাদের বাকি হওয়া টাকা দিতে পারছেন না।’
শহরের সিএমবি রোডে কাপড় বিক্রেতা শাহার আলী জানান, দুই মাস ধরে বেচাকেনা অনেক কম। এই সপ্তাহে শীতের জন্য গরম কাপড় এনেও বসে আছি। হরতাল-অবরোধের কারণে বিক্রি অনেক কমে গেছে।
মাধবদী স্কুল সুপার মার্কেটে আফসানা নামের এক ক্রেতা জানান, কাপড়ের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। প্রতি গজ ভয়েল কাপড় ৬৫ টাকা থেকে থেকে শুরু, পপলিন ৬০ টাকা, বেক্সি ভয়েল দাম চাচ্ছে ১২০ টাকা। যা তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। সে জন্য কাপড় না কিনেই বাড়ি চলে যাচ্ছেন।
মাধবদীতে ভাই ভাই টেক্সটাইলের বুননশ্রমিক শ্রমিক নুরুল হক বলেন, ‘মহাজনরা মেশিন শুধু রাতে চালান। আমাদের প্রোডাকশন অর্ধেক কমে গেছে। কাপড় উৎপাদন ছেড়ে দিয়ে বিকল্প পেশা খুঁজছি।’
নরসিংদীর শিল্প উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আল-আমিন রহমান বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে, ব্যবাসীয়দের সংকট বাড়বে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে, বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে, উৎপাদিত কাপড়ের জন্য কাঁচামাল ক্রয় করা হচ্ছে বেশি দামে। সবমিলিয়ে কাপড় উৎপাদনে খরচ বাড়লেও একইভাবে বেচাকেনা বাড়েনি। এতে ব্যবসায়ীদের লোকসানে পড়তে হচ্ছে।
নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আব্দুল মোমেন মোল্লা বলেন, ‘জেলায় দুই হাজার কারখানা রয়েছে। এই মন্দা বাজারে কাপড় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় অনেক কারখানা মালিক কারখানা ও মেশিন বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে করে কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের আয় কমে গেছে ও বেকার হয়ে পড়ছেন অনেকে। দেশে এখন নির্বাচনের আমেজ বিরাজ করছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক রাজনৈতিক দল তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করছে। দলগুলোকে অনুরোধ করবো ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের স্বার্থের কথা ভেবে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করতে।’
–
সূত্র: খবরের কাগজ-
শাওন খন্দকার শাহিন, নরসিংদী
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০১:১৪ পিএম