কখনো ভোর, কখনো মাঝরাতে, হাইওয়ে থেকে এক চিলছাতে: প্রতি পাতা থেকে চেনা মলাটে, আমি শুধু শুধু খুঁজেছি আমায়; সুরের ছন্দে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে পাহাড়ের কোল ঘেষা আঁকাবাঁকা পথ হেটে গান গেয়ে চলছেন দুই তরুণ। যে গান ভারতের সীমানা পেরিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
‘তালপাতার সেপাই’ নামের এ শিল্পীদের সোস্যাল মিডিয়ায় এখন কে না চেনে? সম্প্রতি বংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমের কাছে গল্পের ঝাপি খুলে দিয়েছিলেন তালপাতার সেপাইয়ের অন্যতম কণ্ঠশিল্পী প্রীতম দাস।
ব্যান্ডের নাম ‘তালপাতার সেপাই’ কেনো?
প্রীতম দাস : তালপাতার সেপাই নামের অর্থ শিশু মনের চিত্তাকর্ষক খেলা। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় একসময় এই খেলা ছোটদের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। কলকাতায় যখন মেলা হতো আমরা গিয়ে খেলতাম। খেলায় তালপাতার সেপাইদের দেখতে খুব হাড্ডিসার মনে হতো, তবুও তাদের শক্তি ছিল। আমরাও এমন ছিলাম গান-বাজনায় বেশি কিছু করা নিয়ে অনেকটা অনিশ্চয়তা ছিল। তবুও তালপাতার সেপাইদের মত নেমে গেলাম এ যাত্রায়। ছোটবেলায় এটা নিয়ে নস্টালজিয়া কাজ করতো, তাই এ স্মৃতিকে ধরে রাখতেই আমরা তালপাতার সেপাই নামকরণ করলাম।
বাংলা গান নিয়ে আপনারদের ভাবনা কী?
প্রীতম দাস : শৈশব-কৈশরের দূরন্ত সময়ে বাংলা গানের প্রতি আমার প্রচণ্ড টান কাজ করতো। সে সময় রবীন্দ্রসংগীত অনেক শুনতাম। এরপর যখন বড় হলাম, তখন থেকে ধীরে ধীরে ওয়েস্টার্ন ব্যান্ড-মিউজিক আর ক্ল্যাসিক্যাল গানগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলাম। একটা সময়ে এসব শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বাংলা গান তৈরিতে কাজ করি। আমরা সবসময় চেয়েছিলাম বাংলা গানকে নতুনত্বের ছোঁয়ায় শ্রোতা-দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে। এখনও সেই প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছি।
আপনাদের মিউজিক ভিডিও’র রহস্য কী?
প্রীতম দাস : তালপাতার সেপাই থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো গান রিলিজ হয়েছে সবগুলোতে আমরা সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে কাজ করেছি। আমাদের কোনো গান রেকর্ড করার আগে ঘর থেকেই বহুবার প্রস্তুতি নেয়া হয়। নতুন কিছু করতে গেলে তো সেটির মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি থেকেই যায়। কারণ, আমরা জানি না এটা করার পর জিনিসটা কেমন হবে বা অডিয়েন্সরা কিভাবে গ্রহণ করবে। তাই সে সবের ব্যাপারে আগে থেকেই রিহার্সেল করি। যাতে নিজেদের ভুল নিজেরাই ঠিক করে নিতে সহজ হয়। সেই সাথে প্রতিটা গানের শুটিং একটু ভিন্নভাবে করার ট্রাই করছি। সবাই তো ভালো ভালো গান গাইতে পারে। সেই গানটির সঙ্গে যদি দৃশ্যমান বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে ধারণ করা যায় তাহলে আমাদের কাজের বৈচিত্র্য আসবে। তাই এ লক্ষ্যটাই আমাদের মূল। যার জন্য অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটা গান প্রকাশ হয়। আমরা চাই সবার থেকে যেন আমাদের গানগুলো একটু আলাদা ও ভিন্নমাত্রা আনুক শ্রোতাদের জন্য।
‘আমি শুধু খুঁজেছি আমায়’ গানটিতে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন…
প্রীতম দাস : ‘আমি শুধু খুঁজেছি আমায়’ এই গানটি দুই বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন দেশে অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। গানটি লিখেছিলেন শ্বাশ্বত রায় ও সুর করেছেন সমব্রত। এটার পেছনেও একটা গল্প আছে। যখন আমাদের গানটা শুনানো হয় সেটা ছিল গিটার ভার্সন। আমরা শোনার পর ভাবিনি যে এতোটা সাড়া ফেলবে। এরপর যখন সেটাকে মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টে আনি তখন এন্টারটেইনিং লাগে। তার সাথে একটা মজাদার দৃশ্যায়ন হয়। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা শেষ দিকে দারুণ চমকপ্রদ হয়েছিল। যা রীতিমতো ভাইরাল হয়।
কোন কাজে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন?
প্রীতম দাস : যেকোনো গানেই নিজেদের আত্মতৃপ্তি পাওয়া আসলে খুব কঠিন মনে হয় আমার কাছে। এখনও মনে হয়, যে গানই আমরা রিলিজ করি সেটাতে ভুল রয়ে গেছে। চেষ্টা করলে হয়তো আরও ভালো করতে পারতাম। এমনটাই মনে হয় সবসময়। তবে এর মধ্যে যদি বলতে বলা হয় তবে বলবো ’আলপিন’ সবথেকে প্রিয় গান। যদিও সেটা এখনও রিলিজ হয়নি। এছাড়াও মধ্যরাতে, ফিরে যাওয়ার পথে, সোনার কাঠি, পথ গেছে বেঁকে এগুলো তো আছেই…
আপনাদের মিউজিক ভিডিওর শুটিং নিয়ে কোনো মজার অভিজ্ঞতা?
প্রীতম দাস : মিউজিক ভিডিও শুটের অসংখ্য মজার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর মধ্যে রিসেন্ট একটা ঘটনা বলি, ‘পথ গেছে বেঁকে’ এই গানটির শুট হয়েছিল লাদাখের দিকে। তখন মাত্র শীতের শুরু, সে সময় জায়গাটিতে ছিল হাড়কাপানো শীত। ওখানকার সড়ক পথটি আঁকাবাকা এবং অনেক উঁচুতে। আমি আর সুমন শুট করছিলাম গাড়ির উপরে বসে। গাড়ি যতই উঁচুতে উঠছিল ততই গা শিরশির করছিল। একে তো ঠান্ডা, আবার উঁচুনিচু পথে এভাবে যাওয়া। তাই এটা খুব কষ্টকর ছিল আমাদের জন্য। তবে প্রাকৃতিক এমন মনোরম দৃশ্যটাও চোখে প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। তো হঠাৎ একসময় খেয়াল করে দেখি, আমাদের গাড়ির ঠিক পাশে একটা আইবেক্স (বিরল প্রজাতির প্রাণি) হেঁটে যাচ্ছে। আমি সুমনকে দেখালাম, সে বললো এটা ছাগল হবে হয়তো। কিন্তু কাজ শেষে যখন আমরা আবার ফিরছিলাম সেই পথ দিয়ে। তখন দেখলাম পুরো আইবেক্সের পাল সরু পাহাড় বেয়ে কি সহজেই উঠে যাচ্ছিলো। খুব বিস্ময়কর এ ব্যাপারটি। কারণ উঁচু পাহাড়গুলোতে প্রাণীদের ওঠা নামার বিরল দৃশ্য অন্যরকম অনুভূতি এনে দিয়েছিলো।
শ্রোতা-দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন-
প্রীতম দাস : কলকাতা ছাপিয়ে বাংলাদেশেও আমাদের গান জনপ্রিয় হচ্ছে- এটা সত্যিই স্বপ্নের মতো। কারোরই প্রত্যাশা ছিল না যে, এতদূর গড়াবে আমাদের কাজ এবং শ্রোতাদের ভালো লাগবে। আর এখানে যেহেতু বাংলা গানের প্রতি একটা সম্পর্ক, অনুভূতি, আবেগ জড়িত তাই ‘তালপাতার সেপাই’ এটুকু পথ অতিক্রম করতে পেরেছে সবার ভালোবাসা পেয়ে। শুধু বাঙালি না, অনেক ভিনদেশি আছেন যারা বাংলা ভাষা-ই বুঝেন না, কিন্তু আমাদের গান শুনেই ভক্ত হয়ে গেছেন। তারা আমাদের নিয়মিত মেসেজ দিয়ে ভালোলাগার কথা জানান। এগুলো ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে সব সময়। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব না।
সাক্ষাৎকারঃ জুনায়েদ হাবীব