লক্ষন বর্মন, নরসিংদী : পরকিয়ার জালে ফাসিয়ে কলেজ ছাত্রকে অপহরন ও হত্যার পর দেহ ৬ টুকরা করে নদীতে ফেলে দেয়ার ১৩ দিন পরও লাশ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে পুলিশ নিহত কলেজ ছাত্র মাহাফুজ ও তার বন্ধু শাহীনের বিরুদ্ধে বলৎকার মামলা নিতে বাধ্য হয়েছেন। যার বাদী রাবেয়া বেগম রাবু । মামলা নং ১৩(৬)১৭ তাং-০৫/৭/১৭। অপরদিকে আঃ মান্নানের দায়েরকৃত অপহরন মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করায় প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন সদর এএসপি সার্কেল মোঃ শাহরিয়ার আলম। তবে খুনী রাবেয়া ইসলাম রাবু ছাড়া উভয় মামলার আসামীরা পলাতক রয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সূত্র থেকে জানা যায়, প্রবাসী আল-মামুুনের স্ত্রী রাবেয়া ইসলাম রাবু নরসিংদী শহরের রাঙ্গামাটিয়া মহল্লার শাহ আলম মোল্লার মালিকানাধীন বাড়ির ৫ তলায় ভাড়া থাকতেন। কলেজ ছাত্র মাহফুজ এই নারীর পূর্ব পরিচিত। বয়সে ছোট হলেও দির্ঘদিন যাবৎ রাবুর সাথে কলেজ ছাত্র মাহফুজের পরকিয়ার সম্পর্ক চলে আসছে। সে সূত্রেই রাবেয়ার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল মাহফুজ ও তার একাধিক বন্ধু। এ সুযোগে সম্প্রতি রাবেয়া ইসলামের ১২ বছরের শিশু ছেলেকে মাহফুজ বলাৎকার করে। এরই ক্ষোভে মাহফুজকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রাবেয়া।
অভিযুক্ত রাবেয়া আক্তার জানিয়েছেন, নরসিংদী ইনডেক্স প্লাাজায় এমডি গার্মেন্টস নামে রাবেয়া ইসলামের একটি দোকানের রয়েছে। সেই থেকে সন্ত্রাসী মাহফুজ ও তার বন্ধু বান্ধবদের সাথে তার পরিচয় হয়। দিনদিন তার সাথে ঘনিষ্ঠতাও হয়ে যায়। এর পর থেকে তারা বাড়িতেও যাওয়া আসা অব্যহত থাকে। রাবু প্রতিনিয়ত দোকান কর্মরত থাকাকালে সন্ত্রাসী মাহফুজ বিভিন্ন সময় আগ্নেআস্ত্র দেখিয়ে আমাদেরকে আতংকিত রাখত। এমনি একদিন মাহফুজ ও তার বন্ধু শাহীন রাবুর ১২ বছর বয়সী ছেলেকে বড়িতে একা পেয়ে তাকে বলৎকার করে। এর পর থেকেই সন্তানের উপর নির্যাতনের বিচার ও প্রতিশোধ নিতে ২৬ মে শুক্রবার মাহফুজকে ডেকে আনেন। খুনি রাবু ও তার কর্মচারী রাজু মিলে মাহফুজকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর দেহ ৬ টুকরা করে ট্রলি ব্যাগে ভরে মেঘনা নদীতেতে ফেলে দেয়।
পুলিশ মোবাইল ট্রেকিং ও খুনী রাবেয়ার সন্দেহ জনক আচরনের কারনে গ্রেফতারের পর বেড়িয়ে আসে প্রকৃত রহস্য। এরই মাধ্যমে নিখোঁজের ১০ দিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদালতে রাবেয়ার ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে উদঘাটিত হয় লোমহর্ষক এই খুনের কাহিনী। রাবেয়ার স্বীকারোক্তির পথ ধরে নরসিংদী থানা পুলিশ মাহফুজকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুরি ও তার ব্যবহৃত কাপড় চোপড় উদ্ধার করেন।
নিহত মাহফুজের স্বজনরা জানিয়েছেন, নিহত মাহফুজ সরকার নরসিংদী সরকারী কলেজের বি.এ দ্বিতীয় বর্ষের নিয়মিত ছাত্র। সে পৌর শহরের বৌয়াকুর এলাকার বাসিন্দা। গত ২৬ মে শুক্রবার বিকেলে মাহফুজ বাড়ী থেকে প্রতিদিনের মত বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে মাহফুজ আর বাড়ী ফিরেনি। তার পিতা আ: মান্নান সরকার ও বড় ভাই রাসেলসহ অন্যান্য আত্মীয়রা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজির পর না পেয়ে ২৭ মে নরসিংদী সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করে। পরদিন মাহফুজের মোবাইল থেকে একটি কল আসে তার বড় ভাই এড. রাসেলের মোবাইল ফোনে। এই ফোন নাম্বার থেকে রাসেলকে জানানো হয় যে, মাহফুজ বর্তমানে তাদের হেফাজতে রয়েছে। মাহফুজকে ফিরে পেতে ১ লাখ টাকা মুক্তিপন চান। এ কথা বলে রাসেলকে ৪টি বিকাশ ও ৩টি রকেট নাম্বার দেন। পরে অন্য নাম্বার থেকে কল দেয়া হবেও জানান। এরপর রাসেল ও তার পিতা আ: মান্নান সরকার অনন্যোপায় হয়ে মাহফুজকে বাঁচানোর জন্য ৩টি রকেট নাম্বারে ১ লক্ষ টাকা পরিশোধ করেন। এরপরও তারা মাহফুজকে ফেরত পেয়ে নরসিংদী সদর থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করে।
২৮ মে নরসিংদী শহরের রাঙ্গামাটিয়া মহল্লার প্রবাসী আল-মামুুনের স্ত্রী ইনডেক্স প্লাাজার এমডি গার্মেন্টস নামে একটি দোকানের মালিক রাবেয়া ইসলাম রাবু, মাহফুজের বাড়ীতে গিয়ে তার নিখোঁজের ব্যাপারে অযাচিত খোঁজখবর নেন। মাহফুজের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের নিকট সহানুভূতি প্রকাশ করেন। মাহফুজ তার নিকট থেকে টাকা ধার নিতো, আবার দিয়ে দিতো। তার সাথে খুবই সু-সম্পর্ক ছিল। এসব কথা বলে রাবু, মাহফুজকে খোঁজাখুজি করার জন্য বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন ব্যক্তির নাম ঠিকানা দেয়। রাবু’র এধরনের কথা বার্তায় মাহফুজের পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করলে তারা ঘটনাটি অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নরসিংদী থানার এসআই নুরে আলমকে জানায়। এসআই নুরে আলম ঘটনা বিস্তারিত জেনে মোবাইল ফোনে রাবুকে থানায় যেতে বলে। এসআই নুরে আলম তাকে থানায় আটকে রেখে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু সে কোন রহস্যে কথা স্বীকার না করায়
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহরিয়ার আলম ও ওসি গোলাম মোস্তফা যৌথভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এতেও সে পুলিশকে কোন ক্লু দেয়নি। রাতে পুলিশ তাকে পুলিশ সুপার আমেনা বেগমের সামনে উপস্থাপন করেন।
পুলিশ সুপার আমেনা বেগম দীর্ঘ সাথে তার কথা বলে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তিনি তাকে গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পর মাহফুজকে খুনের কথা স্বীকার করেনূ। পরদিন মঙ্গলবার তাকে নরসিংদীর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ফেরদৌস ওয়াহিদের নিকট হাজির করলে সেখানে রাবু ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন।
এতে সে স্বীকার করে যে, ২৬ মে রাতে বাড়ী থেকে বের হবার পর সে মাহফুজকে ডেকে তার বাড়ীতে নেয়। সেখানে ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে রাবু তাকে জড়িয়ে ধরে। এসময় রাবুর ভাগিনা শাহাদাৎ হোসেন রাজু তাকে পিছন দিক থেকে এলোপাতারি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। তার মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর রাবু ও তার ভাগিনা শাহাদাৎ হোসেন রাজু মিলে তার মৃত দেহটি ৬টি খন্ডে খন্ডিত করে ঘরে থাকা ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে। পর দিন শনিবার ফ্রিজ থেকে খন্ডিত দেহটি একটি ট্রলি ব্যাগে ঢুকিয়ে নৌকা ঘাটে গিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ট্রলিব্যাগে ভর্তি লাশটি নিয়ে পাশ্ববর্তী বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মরিচাকান্দী এলাকায় মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়।
নরসিংদী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহরিয়ার আলম জানান, অপহরন ও মুক্তিপনের টাকা লেনদেনের পর অভিযোগটি নিয়ে পুলিশ অভিযানে নামেন। সন্দেহ জনক গতিবিধি ও মোবাইল ট্রেকিং করে মহিলাকে আটক করা হয়। অন্য আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ঘটনাস্থল শনাক্ত করার পর ডুবুরী দল নিয়ে তল্লাশী চালালেও লাশের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে পাশ্ববর্তী থানাগুলোতে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠানো হয়েছে। মাহফুজ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ছিলেন। তার নামে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।