ব্যবসায়ী : আসসালামু আলাইকুম বস।
ওসি : ওয়াআলাইকুম আসসালাম, কে?
ব্যবসায়ী : বস, আসলাম শেখ বলছি ঢাকা থেকে।
ওসি : আজকে কী বার?
ব্যবসায়ী : আজকে বস বুধবার, সরি বস।
ওসি : হা হা হা হা হা… এ রকমই সরি হয় মানুষের।
ব্যবসায়ী : বস, এখন আমি টিভিটা দেখছি শোরুমে।
ওসি : অ্যা…অ্যা…অ্যা।
ব্যবসায়ী : বস, এখন আমি যদি ৪৮ কিংবা ৪৯ ইঞ্চি টিভি দিই তাতে কি কোনো সমস্যা হবে?
ওসি : না, ও হা আমি নিতাম না। আমার কাছে এখন ৫২ ইঞ্চি একটা আছে, আমার এখন ৬৫ ইঞ্চি টিভি দরকার।
ব্যবসায়ী : তার মানে বর্তমানে আমার ক্লোজিং মাস। আমার পোল্ট্রিতে অনেক সমস্যা, প্রতি মাসে লোকসান দিচ্ছি।
ওসি : টাকা কম হলে তাহলে নগদ টাকা দিয়ে দেন।
বাকি কিছু লাগলে অন্য আরেকজনের কাছ থেকে নিয়ে নিবনে।
ব্যবসায়ী : আচ্ছা বস এটা হলে একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি।
ওসি : ৬৫ ইঞ্চি টিভির দাম কিন্তু তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আপনি ৫২ ইঞ্চি টিভির দাম দিয়ে দেন আমি আরেকজনের কাছ থেকে বাকিটা নিয়ে নিবনে।
ব্যবসায়ী : স্যার টিভির দাম ৬৫ হাজার টাকা?
ওসি : না, না, তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
ব্যবসায়ী : ও আচ্ছা।
ওসি : ৫২ ইঞ্চি টিভির দামই তো দেড় লাখ টাকার মতো।
ব্যবসায়ী : স্যার আমি তো কষ্টে আছি। এত টাকা দিব কিভাবে? আর বুঝতেও পারি নাই টিভির দাম এত।
ওসি : আচ্ছা আপনি যেটা পারেন সেটাই দিয়ে যাইয়েন আর কি। ঠিক আছে ভাই।
ব্যবসায়ী : আচ্ছা ভাইজান।
গত ২৭ ডিসেম্বর রাত ৮টা ৫১ মিনিট থেকে নরসিংদীর মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমামের সঙ্গে ব্যবসায়ী আসলাম শেখের এই ফোনালাপ হয়। এই রেকর্ড কালের কণ্ঠ’র কাছে সংরক্ষিত আছে।
মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদুর রহমান লক্ষুর দুই ছেলে আসলাম শেখ ও মো. ছালাম শেখকে ভুয়া ডাকাতির মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুষ হিসেবে ওই টিভি চেয়েছিলেন ওসি রুহুল ইমাম। দাবি অনুযায়ী টেলিভিশন দিতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের অশ্লীল গালাগাল করান তিনি। এমনকি টেলিভিশন দিতে না পারলে এলাকাছাড়া করা এবং ডাকাতি মামলায় জেল খাটানো হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন ওসি।
ওই ঘটনার পর ব্যবসায়ী ছালাম শেখ নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার এই সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চালাকচর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান দেশ স্বাধীনের ১০ বছর পর হৃদরোগে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর কঠিন সংগ্রাম করেই বেড়ে ওঠেন দুই ভাই আসলাম ও ছালাম। চালকচর বাজারে পৈতৃক সম্পত্তিতে ১৬ বছর ধরে তাঁরা সুনামের সঙ্গে শেখ পোল্ট্রি ফিড অ্যান্ড মেডিসিন নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আসছেন।
মুক্তিযোদ্ধার দুই সন্তান জানান, পোল্ট্রি ব্যবসার কারণে প্রতি মাসে বিভিন্ন কম্পানির কাছ থেকে পোল্ট্রির ফিড কিনে থাকেন তাঁরা। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা গত ২৯ জুলাই মেসার্স মক্কা মদিনা পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে ২০ টন মুরগির খাবার কেনেন। ওই দিন সন্ধ্যায় ২০ টন মাল বুঝিয়ে দেন ওই পরিবহন সংস্থার ট্রাকের মালিক, পাশের শিবপুর উপজেলার চক্রধা ইউনিয়নের গির্জাপাড়া গ্রামের মো. ওদুদ ভূঁইয়ার ছেলে মো. সুলেমান ভূঁইয়া। সুলেমানের নিজস্ব ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো-ট ১৮-৭৬৫৩) মাধ্যমে ওই মাল সরবরাহ করা হয়। মাল এবং চালান বুঝে পেয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতেই সুলেমানকে পোল্ট্রি ফিডের দাম ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকা নগদ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
শেখ পোল্ট্রি ফিডের মালিক আসলাম শেখ ও ছালাম শেখ কালের কণ্ঠকে জানান, ওই ঘটনার প্রায় সাড়ে চার মাস পর হঠাৎস নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের লাকসাম ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির ম্যানেজার রুবেল মিয়াসহ কয়েকজন তাঁদের কাছে ডাকাতি করা মাল বিক্রি করা হয়েছে দাবি করে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। বিষয়টি জানার পর তাঁরা সেই মক্কা মদিনা পরিবহনের সুলেমান ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সুলেমান জানান, তিনি লাকসাম ট্রান্সপোর্টকে সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে আট লাখ টাকার চেক এবং নগদে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। সোলায়মান অভয় দিয়ে বলেন, ‘মাল আমি দিয়েছি এবং টাকা আমি নিয়েছি। আপনাদের কোনো ঝামেলার কিছু নেই। ’
ওই ঘটনায় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানায় হওয়া একটি জিডির কথা উল্লেখ করে আসলাম ও ছালাম জানান, সোলেমান ভূঁইয়া লাকসাম ট্রান্সপোর্টের মালিক মফিজুল হককে আট লাখ টাকার চেক এবং নগদ এক লাখ টাকা দেওয়ার বিষয়টি গজারিয়া থানার ওসি হারুন উর রশিদও নিশ্চিত করেছেন। এর পরও কখনো মফিজুল খান, কখনো রুবেল বারবার পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন, না দিলে ডাকাতি মামলায় তাঁদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
ব্যবসায়ী আসলাম শেখ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফিডের মাল বুঝে পেয়ে টাকাও পরিশোধ করি ঠিকমতো। এখন মাল কিনে বিপদে আছি। যে ব্যক্তি আমাদের প্রতিষ্ঠানে মাল সরবরাহ করেছেন তাঁর ট্রাকও আটক করা হয়েছে। মালগুলো চুরি কিংবা ডাকাতির মাল কি না সন্দেহ করে মনোহরদী থানায় আমি নিজেই একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছি এবং মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমামকে বিষয়টি অবহিত করি। ওই সময় ওসি সাহেব আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে চিন্তা করতে মানা করেন। ’
আসলাম শেখ বলেন, “২৩ ডিসেম্বর থানায় জিডি করতে যাওয়ার পর ওসি গাজী রুহুল ইমাম আমাকে বলেন, ‘জিডি আপনার নিলাম, যারা আপনাকে হয়রানি করতে চাইতেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। কিন্তু আমাকে আপনি একটা ৬৫ ইঞ্চি স্যামসাং স্মার্ট টেলিভিশন কিনে দিবেন। ’ ওই সময় আমি আপত্তি করলেও তিনি পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। নইলে ডাকাতি মামলার আসামি করার ইঙ্গিত দেন। ”
আসলাম জানান, সেদিনের পর গত ২৭ ডিসেম্বর মোবাইলে ওসি গাজী ইমামকে তাঁর ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো না জানিয়ে ছোট টেলিভিশন দিতে চাইলেও তিনি মানেননি। এরপর গত ২৯ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ২টার দিকে মনোহরদী থানার এসআই সাখাওয়াত হোসেনসহ পুলিশের একটি দল চালাকচর বাজারের পাশে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দরজায় রাইফেল দিয়ে আঘাত করে এবং অশ্লীল গালাগাল করতে থাকে। তখন আসলামের মা সাহেরা বেগম দরজা খুলে দিলে তাঁকেও নানাভাবে অপমান করা হয়।
সেই রাতের তাণ্ডবের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী সাহেরা বেগম বলেন, ‘সেই দিন দরজা খুলে আমি বলি এটা মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি এবং আমি মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। ’ এটা শুনে ওই পুুলিশ উচ্চ স্বরে বলতে থাকে, ‘কিসের মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি, এটা ডাকাতের বাড়ি, এক ছেলে ডাকাত আরেক ছেলে চোর। ’
সাহেরা বেগম বলেন, ছেলেদের নামে কোনো মামলা আছে কি না জানতে চাইলে এসআই সাখাওয়াত বলেন, ‘চোর-ডাকাতের আবার মামলা লাগে নাকি। ’
ব্যবসায়ী আসলাম শেখের স্ত্রী মোমেলা বেগম বলেন, ‘প্রথমে মনে করেছিলাম ডাকাত এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে দেখি পুলিশ, হাতে অস্ত্র। তারা নানাভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখায় এবং আমার দেবর ও স্বামীকে সকালেই থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করতে বলে। ’
আসলাম শেখ জানান, ব্যবসায়িক কাজে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন তিনি। রাতে বাড়িতে পুলিশ যাওয়ার বিষয়টি জানতে চেয়ে ওসি গাজী রুহুল ইমামের মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে ওসি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘তুই আমারে চিনিস না, আমি তোকে ডাকাতি মামলা দিব। ’ এ কথা বলেই লাইনটি কেটে দেন ওসি।
চালাকচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফখরুল মান্নান মুক্তু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওসি ঘুষ হিসেবে টেলিভিশন চেয়েছেন আসলাম শেখ এই অভিযোগ আমার কাছে করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কাছে এ ধরনের দাবি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এর বেশি কিছু আমি ভাই বলতে পারব না। ’
নরসিংদী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মোতালেব পাঠান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির কাছেই এ ধরনের ঘুষ চাইতে পারে না পুলিশ। যাদের কাছে এমন দাবি করা হয়েছে তারা আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা তাঁর পাশে থাকব। ’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, যার কাছে এমন দাবি করা হয়েছে সেই ব্যক্তি প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ নিয়ে এলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী আসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি গাজী রুহুল ইমাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডাকাতি মামলার আসামিরা তো কত কিছুই বলতে পারে। ’ তখন ওই দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না থাকলে হতে পারে। ’
আর ঘুষ হিসেবে টেলিভিশন দাবি করার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি দম্ভ দেখিয়ে বলেন, ‘চেয়ে থাকলে অপরাধ করছি, আপনি যা পারেন লিখে দেন। ’
সূত্র: কালেরকণ্ঠ