বিশ্বের যে ৮ থেকে ১০ দেশে যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যক্ষ্মায় প্রতি ১২ মিনিটে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। সে হিসাবে দিনে মৃত্যু হচ্ছে ১০০ জনের। অথচ যক্ষ্মার চিকিৎসা রয়েছে দেশে। সরকার বিনা মূল্যে যক্ষ্মার ওষুধ দিচ্ছে। তার পরও এত মৃত্যুর নেপথ্য কারণ হলো, যক্ষ্মা নিয়ে মানুষের অসচেতনতা এবং রোগী শনাক্ত না হওয়া।
গ্লোবাল টিবি রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৯৪২ জন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রতি লাখে ২২১ জন নতুন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয় এবং প্রতি লাখে ২৪ জন মৃত্যুবরণ করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিবি-এল এবং এএসপি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজার রহমান জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখ যক্ষ্মা রোগীর মধ্যে ৪৫ জনের মৃত্যু হতো, সেখানে ২০২১ সালে মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের।
তবে এ সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো যক্ষ্মার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখানে প্রতি মিনিটে একজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। ২০২১ সালে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ৪২ হাজারের। অর্থাৎ প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মায় একজনের মৃত্যু হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুবাহিত এই রোগটি সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি আক্রমণ করে। সেই সঙ্গে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি।
তাদের বক্তব্য, দেশে যক্ষ্মা নির্মূলে এখনো কিছু সংকট আর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। আবার দেশে এমন কিছু ‘হার্ড টু রিচ’ এলাকা রয়েছে, যেখানে এখনো স্বাস্থ্যসেবা ঠিকমতো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এসব কারণে রোগী শনাক্ত একটি কঠিন বিষয়। যার কারণে এখনো দেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন যক্ষ্মারোগী থেকে কমপক্ষে ছয়জনে রোগটি ছড়াতে পারে। তাই কোথাও একজন যক্ষ্মারোগী পাওয়া গেলে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কমপক্ষে ছয়জনকেই পরীক্ষা করাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ‘দেশ থেকে টিবি নির্মূল করতে চাই’ মন্তব্য করে বলেন, কিন্তু দিনকে দিন এর জটিলতা বাড়ছে। বিশেষ করে হাড়, অন্ত্র, জরায়ু এবং অস্ত্রোপচারস্থলে যক্ষ্মার সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে বেশি, যা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে অস্ত্রোপচারসংক্রান্ত যক্ষ্মা নির্ণয় ও প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এই কিছুদিন আগেও যক্ষ্মা কেবল বড়দের রোগ হিসেবে চিহ্নিত হতো। ধারণা করা হতো শিশুরা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় না। কিন্তু শিশুরাও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের বড়দের কাছ থেকেই এতে সংক্রমিত হচ্ছে।
যক্ষ্মা নির্মূলে কিছু ক্ষেত্রে এগোলেও শতভাগ রোগী শনাক্ত করতে না পারায় বাংলাদেশ এখনো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তিনি বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে ৭০ শতাংশ যক্ষ্মারোগী রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেশ সফল হলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনো কাজ করতে হবে।
যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, যক্ষ্মা একেবারে নির্মূল না করতে পারার পেছনে রোগী শনাক্ত না করতে পারা অন্যতম কারণ। কারণ, যক্ষ্মা হলে মানুষ তাকে প্রকাশ করতে চায় না। এর পেছনে রয়েছে কুসংস্কার এবং সামাজিক স্টিগমা।
একজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে সমাজে একঘরে করার উদাহরণও রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকে যক্ষ্মার লক্ষণ থাকলেও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে রোগটি লুকিয়ে রাখে। এ কারণে রোগটি শতভাগ নির্মূল করা যাচ্ছে না।
যক্ষ্মা রোগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী সংস্থা ইউএসএআইডি। ইউএসএআইডির বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. সামিনা চৌধুরী। তিনি ১৮ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে সঠিক সময়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা নিতে পেরেছিলেন তিনি। সে কথা জানিয়ে ড. সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘আমার রোগটি সঠিক সময়ে শনাক্ত হয়েছিল বলে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছি। এ জন্য রোগটি শনাক্তে জোর দিতে হবে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিন্তু একে নির্মূল করতে হবে।’
দেশে যক্ষ্মা নিয়ে অনেক কাজ হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মূল করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ মানুষ সচেতন যেমন নয়, তেমিন রোগীও ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না বলে দৈনিক বাংলাকে বলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
তিনি বলেন, ‘সব রোগীকে স্ক্রিনিং বা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না দেশে। দেশের অনেক এলাকায় আমরা ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পারছি না। আর রোগী শনাক্ত না করতে পারার কারণে তাদের চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছে না।’
ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কিছু সংকট রয়েছে, রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। অনেক উপজেলায় যন্ত্রপাতি নেই, যন্ত্রপাতি খারাপ রয়েছে, এমনও আছে। সেসব জায়গায় যন্ত্রপাতি পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছি আমরা। এসব সীমাবদ্ধতা যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল করা অসম্ভব হবে না।’