থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্তরোগ। এটি জিনবাহিত অসুখ, যা জিনের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পরিবাহিত হয়। আমাদের রক্তের লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিন নামে বিশেষ এক ধরনের রঞ্জক উপাদান থাকে। এটি অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে। জিনগত কারণে এই হিমোগ্লোবিনের গঠনে বা তৈরি প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দিলে এর উৎপাদন ব্যাহত হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে লোহিত রক্ত কণিকার আয়ুষ্কাল কমে এবং সেগুলো সহজেই ভেঙে যায়। এ অবস্থায় শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। আর তা থেকে দেখা দেয় নানা রকম উপসর্গ। এটিই হলো থ্যালাসেমিয়া।
থ্যালাসেমিয়া অনেক রকমের আছে। সহজ করে বলা যায়, এই রক্তরোগ প্রধানত দুই প্রকার: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। এমনকি এর উপসর্গও অনেক সময় বোঝা যায় না। বিটা থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দুই রকমের হতে পারে। একটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এদের থ্যালসেমিয়া ট্রেইট বা ক্যারিয়ার বলে। অপরটি থ্যালাসেমিয়া মেজর।
থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট মূলত রোগটির বাহক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এতে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেকে হয়তো অজান্তেই সারা জীবন এই রোগ বহন করে চলেন। অল্পকিছু ক্ষেত্রে মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। বাবা ও মা উভয়ে থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট হলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া মেজরে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ। ক্যারিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ ভাগ।
ক্লান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, শ্বাসকষ্ট, ত্বক ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি হলো থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস হয়। প্রস্রাবও হলুদ হতে পারে। প্লীহা বড় হয়ে যায়। যকৃতও বড় হয়ে যেতে পারে। অস্থি বা হাড় পাতলা হয়ে যেতে থাকে। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়। নাকের হাড় দেবে যায়। মুখের গড়ন পাল্টে যায়, যাকে ‘মংগোলয়েড ফেস’ বলা হয়। শরীরের বৃদ্ধি কমে যায়। আস্তে আস্তে দেখা দেয় বিশেষ কিছু জটিলতা।
রোগীর শরীরে ঘন ঘন রক্ত দিতে হয় বলে তার শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই আয়রন জমা হয় হৃৎপিণ্ডে, যকৃতে, অগ্ন্যাশয়ে। এই পর্যায়টি মারাত্মক। দেখা যায়, অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ার কারণে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী নানাবিধ শারীরিক জটিলতার কারণে মারাও যেতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া শনাক্ত করার সবচেয়ে চালু পদ্ধতিটি হলো রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা। আমাদের দেশে ঢাকার বাইরে এই পরীক্ষার সুযোগ খুবই সীমিত। রক্তের রুটিন পরীক্ষা (সিবিসি) থেকে থ্যালাসেমিয়ার সম্ভাবনা আঁচ করা যায়। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করেও এই রোগ ধরা যায়।
রক্ত পরিসঞ্চালনই থ্যালাসেমিয়ার মূল চিকিৎসা। আয়রন বেড়ে গেলে আয়রন চিলেশনের ওষুধ দিয়ে তা কমাতে হয়। প্লীহা অতিরিক্ত বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে প্লীহা কেটে ফেলতে হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হার কিছুটা কমে আসে। মূলত, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হলো এর স্থায়ী চিকিৎসা। জিন থেরাপিও এই রোগের আরেকটি উন্নত চিকিৎসা। কিন্তু এসব চিকিৎসা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
তাই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। সরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, গণমাধ্যম সব পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
লেখক: রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।